যন্তরমন্তরে কৃষকদের সমাবেশ। —ফাইল ছবি
বাম রাজনীতি অস্তমিত। বাম সমাজ-আদর্শের খোঁজ পাওয়াও আজকাল দুষ্কর। এমতাবস্থায় রাজধানীর রাজপথ যে লাল পতাকায় ভরিয়া যাইতে পারে, কৃষক-শ্রমিকদের যৌথ আন্দোলনের ডাকে যে সাড়া মিলিতে পারে, এ কে গোপালন ভবনের তাত্ত্বিক নেতারা কি তাহা ভাবিয়াছিলেন? কয়েক মাস পূর্বে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের বিপুল মিছিল ও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে সফল কর্মসূচি তাঁহাদের কি এতটুকুও ভাবাইতে পারিল? মুশকিল এই যে, প্রতিবাদের রাজনীতি তৈরি করিতে গেলে কোনখানে সাড়া মিলিতে পারে, আর কোনখানে ততখানি নহে, এই বিবেচনাবোধটিও তাঁহাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নাই। বহু তর্জনগর্জন সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত শহুরে মধ্যবিত্ত যে অপশাসনের প্রতিবাদে শামিল হইতে দ্বিধান্বিত, কৃষক-মজদুরদের ক্ষেত্রে যে সে কথাটি খাটে না, এই বার্তা সাম্প্রতিক কালে আর এক বার প্রকট হইল। যে দিন দিল্লির কৃষক মিছিল কর্মসূচি সফল হইল, তাহার কয়েক দিনের মধ্যেই পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ডাকা ভারত বন্ধ-এ কিন্তু দেশের শহর-মফস্সলে তেমন সাড়া মিলিল না। বন্ধ সফল না হওয়া যে কোনও সময়েই দেশের পক্ষে সুসংবাদ, কিন্তু কয়েক দিনের ব্যবধানে একটি সাফল্য ও একটি ব্যর্থতাকে একই সঙ্গে পড়িলে বোঝা যায়, সরকারবিরোধিতার আন্দোলন প্রসারিত করিতে হইলে ঠিক কোন প্রশ্ন লইয়া কোন ধরনের মানুষের নিকটে যাওয়া এই মুহূর্তে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
এই মুহূর্তে উপলব্ধিটির রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল অনেক। পেট্রল-ডিজ়েলের মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের গায়ে আঁচ লাগিয়াছে বটে; ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমাতেও হয়তো মধ্যবিত্ত অস্মিতা আহত হইয়াছে। কিন্তু, এখনও অবধি সেই ধাক্কা মধ্যবিত্তের বাজারের থলিতে প্রত্যক্ষ থাবা বসায় নাই। বর্তমান জমানায় প্রকৃত ধাক্কা খাইয়াছেন শ্রমিক ও কৃষকরা। বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে নোটবন্দি এমনই তীব্র প্রভাব ফেলিয়াছে যে দুই বৎসরেও সেই ক্ষত নিরাময় হয় নাই। অন্য দিকে, ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ায় কৃষিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়িয়াছে, কিন্তু তাহাতে কৃষকের সমস্যার নিরসন হয় নাই। অতএব বিজেপি-বিরোধিতাও তাঁহাদের মধ্যে তীব্রতর হইতেছে, রামমন্দিরের গল্পগাছায় তাঁহাদের ভুলানো মুশকিল। সীতারাম ইয়েচুরিরা যে এই রাজনীতির সন্ধান পাইতেছেন না, তাহা বিস্ময়কর বটে।
কেবল বাম দলগুলির ক্ষেত্রে নহে। কৃষক-শ্রমিকদের এই দেশব্যাপী ক্ষোভকে সংগঠিত করা এখন বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির সব কয়টি ধারার প্রধান লক্ষ্য হইবার কথা ছিল। দুই-এক দিনের মিছিল-সমাবেশ নহে, ধারাবাহিক প্রতিরোধ সংগঠন করিবার সুযোগ ছিল। তাহার সঙ্গে, শ্রেণিবিক্ষোভের পাশাপাশি জাতগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বও দরকার ছিল। জাতভিত্তিক বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করিবার জন্য নহে, বরং এই কারণে যে এ দেশে চির কালই কৃষক-মজদুরদের একটি বড় অংশ নানা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীভুক্ত। বর্তমান শাসনে তাঁহাদের ক্ষোভ অতি তীব্র। শ্রেণিগত বৈষম্য ও আইডেন্টিটিগত বৈষম্যের প্রতিরোধ সংগঠনে সেই ক্ষোভের প্রতিনিধিত্ব করিতে না পারিলে এত বড় রাজনৈতিক সুযোগও হারাইয়া যাইবে। নেতৃত্বের অভাবে জনক্ষোভের বাস্তব কালের গর্ভে ডুবিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy