Advertisement
০২ মে ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু

১৯৪০ সালের ২৪ মার্চ লাহৌরে মুসলিম লিগের সম্মেলনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করে মুসলমানদের একটি জাতি হিসাবে গণ্য করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার নামে পাকিস্তান নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপিত হয়।

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দেশভাগ ও বাংলাভাগ

সুগত বসু লিখেছেন, ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি যখন ঘোষণা করেন ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবে তখন হিন্দু মহাসভাই প্রথম পঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল (‘ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথ’, ১৫-৮)। তিনি সত্য কথাই বলেছেন। কিন্তু অর্ধসত্য বলেছেন। তাই কী পরিস্থিতিতে হিন্দু মহাসভা বিভাজনের এই প্রস্তাব দিয়েছিল, তা না বলে এই বিভাজনের জন্য শুধু হিন্দু মহাসভাকে দায়ী করা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা ভাবতে হবে।

১৯৪০ সালের ২৪ মার্চ লাহৌরে মুসলিম লিগের সম্মেলনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করে মুসলমানদের একটি জাতি হিসাবে গণ্য করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার নামে পাকিস্তান নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপিত হয়। এই দাবিতে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর হিন্দু মহাসভা অশনি সংকেত দেখতে পান। এই দাবি উত্থাপনের ১৫ দিনের মধ্যে শ্রীহট্টে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার এক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুখোপাধ্যায় দেশভাগের চক্রান্তকে সমূলে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য দেশপ্রেমী ভারতবাসীর কাছে আহ্বান জানান। পরবর্তী ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে ভাষণদান কালে পাকিস্তান প্রস্তাবের অসারতা ও দেশবিভাগের বিষময় পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে তিনি সজাগ করার চেষ্টা করেন। এমনকী মুসলিম লিগ নেতাদেরও আহ্বান জানান, ব্রিটিশদের ফাঁদে পা না দিয়ে রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরে আসার। তিনি ভারত বা বাংলা কোনও বিভাগেরই সমর্থক ছিলেন না। তাঁর সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত রূপে গৃহীত হয়।

কিন্তু জিন্নার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। মুসলিম লিগের ভাড়াটে গুন্ডাদের অকথ্য নিষ্ঠুর অত্যাচারে পঞ্জাবের হিন্দু ও শিখরা যখন সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছেন তখন তাঁরা দাবি তুললেন যে, কোনও মতেই পুরো পঞ্জাবকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে দেওয়া যাবে না। শেষ রক্ষা হিসাবে তাঁরা পঞ্জাব ভাগেও রাজি। হিন্দু ও শিখদের এই কঠিন মনোভাব জানিয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু লর্ড ওয়াভেলকে জানিয়ে দেন যে, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পঞ্জাব ভাগ করা ছাড়া পঞ্জাবের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ব্রিটিশ সরকারও তা উপলব্ধি করতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট কলকাতার বুকে ডিরেক্ট অ্যাকশন বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নামে মুসলিম লিগ মুসলমান গুন্ডাদের লাগিয়ে যে ভাবে নিষ্ঠুর, অকথ্য, বর্বরোচিত উপায়ে হিন্দু নিধন যজ্ঞ চালিয়েছিল, তা দেখে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা উপলব্ধি করে যে পঞ্জাবের মতোই অখণ্ড মুসলিম গরিষ্ঠ বাংলায় হিন্দুদের রক্ষা করা একেবারেই অসম্ভব। যেন-তেন-প্রকারেণ এই ব্যবস্থা রুখতেই হবে। তৎকালীন বাংলার অনেক কংগ্রেস বুদ্ধিজীবীও মনে করছিলেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগই কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দুদের রক্ষা করতে পারে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি বাংলা ভাগের দাবি-সহ হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গকে ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে।

বাংলা ভাগের দাবি জোরদার হতেই শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশংকর রায় শেষ রক্ষা হিসাবে স্বাধীন যুক্ত বাংলা গঠনের দাবি জানান। সুরাবর্দীও বললেন, কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলা গড়তে পারলে বাংলা হবে সুখী ও সমৃদ্ধ।

এই সময়ে শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা বাংলা ভাগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। শ্যামাপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাগ ছাড়া বাঙালি হিন্দুদের বাঁচানো যাবে না। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং যুক্তি দিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে যদি মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা যায়, তবে বাংলা ভাগ করে বাংলার যে অংশে হিন্দুরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ তাদেরও পৃথক জাতি হিসাবে গণ্য করে, মুসলিম অধ্যুষিত অখণ্ড বাংলায় বসবাস করতে বাধ্য না করে, তাদের জন্য পৃথক প্রদেশ গঠন করে হিন্দু ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে দেওয়ার বাধা থাকা উচিত নয়। ব্রিটিশ সরকার এই যুক্তি স্বীকার করে পঞ্জাবের সঙ্গে বাংলা ভাগের দাবির মান্যতা দেয়। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন বলেছিলেন, ‘ইউ হ্যাভ ডিভাইডেড ইন্ডিয়া অ্যান্ড আই হ্যাভ ডিভাইডেড পাকিস্তান।’

উৎপলেন্দু সরকার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রায়গঞ্জ

আশ্বাসভঙ্গ

সুগত বসুর প্রবন্ধটিতে (১৫-৮) ভারতে বহুসংস্কৃতিবাদের অবক্ষয় নিয়ে উদ্বেগ এবং বহুমাত্রিক সত্তাকে স্বীকৃতিদানের প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ সময়োপযোগী। উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গঠনই প্রগতিশীল দেশবাসীর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এই লক্ষ্য পূরণে শুধু এক গোষ্ঠীর সমালোচনার পরিবর্তে দেশ জুড়ে বহু গোষ্ঠীর দেশবিরোধী কার্যকলাপকেও আলোচনার মধ্যে আনা বিধেয়। জঙ্গি হিন্দুত্ববাদই শুধু নয়, জঙ্গি ইসলামিক বিভিন্ন সংগঠন সামলে দেওয়ার বিষয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। জমিয়ত-উলেমা-ই-হিন্দ-এর তিরিশতম সম্মেলন ২০০৯-এর ৩ নভেম্বর দেওবন্দে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাংবাদিক গৌতম রায় একটি প্রতিবেদনে (আনন্দবাজার, ১০-১১-২০০৯) দার-উল উলমের ২৫টি প্রস্তাব বা ফতোয়ার অধিকাংশই পিছুটানের লক্ষণাক্রান্ত বলে দেখিয়েছিলেন, যেমন ইউপিএ সরকারের কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা বোর্ড গঠন ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা বিস্তারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা, সব ক্ষেত্রে মুসলিমদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (আধুনিক শিক্ষা না থাকলেও সরকারি কর্মসংস্থানের দাবি), মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন আইনসভায় সংরক্ষণের বিরোধিতা ইত্যাদি। গোটা দেশে মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠীর অশান্তি সৃষ্টির নানা অপপ্রয়াস দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

প্রবন্ধটিতে বিবেকানন্দের কথায় ইসলামের সাম্যনীতির সপ্রশংস উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, শিয়া, সুন্নি, আহমদিয়া, কুর্দ ইত্যাদি নানা মুসলিমদের মধ্যে সংঘাত প্যান-ইসলামিক ঐক্যের ধারণাকে প্রত্যহ বিপন্ন করছে।

প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা যে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে আসবে। আর তখনই হিন্দু মহাসভা প্রথম বাংলা ও পঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল। এটাও বলা দরকার যে হিন্দু মহাসভা অখণ্ড ভারতই চেয়েছিল। কিন্তু জিন্না অনড় থেকে বললেন পাকিস্তানই (অর্থাৎ দেশবিভাজনই) একমাত্র সমাধান। দেশ যদি দ্বিখণ্ডিতই হয়, তা হলে বাংলা ও পঞ্জাবে মুসলিম লিগ শাসনের চেয়ে বিভাজনই শ্রেয় বলে হিন্দু মহাসভা মনে করে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই দাবি ১৯৪৭-এর জানুয়ারি মাসে বড়লাটকে জানান। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দুদের শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাসের ব্যবস্থা জানিয়ে ছিলেন ভারত সচিব লিস্টওয়েলকে ১৯৪৭-এর মে মাসে যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মেঘনাদ সাহা। অধ্যাপক অমলেন্দু দে এবং অন্নদাশঙ্কর রায় শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করে অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব অবাস্তব বলে অভিহিত করেন।

দেশভাগের সময় গাঁধীজি এবং নেহরুজি পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁরা ভারতে আশ্রয় পাবেন। নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতে (১৯৫০) হিন্দুদের যাবতীয় নাগরিক অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কাজে কী হয়েছে তা সবাই জানেন। স্বাধীনতার পর পশ্চিম সীমান্তে কার্যত সংখ্যালঘু বিনিময় ঘটে যায়। পূর্ব সীমান্তে নেহরু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতে চলে আসতে নিরুৎসাহ করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি পালনের জন্য লোকবিনিময়ে রাজি হন না। ১৯৪৮ সালে নেহরু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে লেখেন— প্রথম থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে না আসেন। উদ্বাস্তুদের যেন সাহায্য না করা হয়। সেই নীতি পশ্চিমবঙ্গের সমাজের ক্ষতি করেছিল কি না, বিশেষজ্ঞরাই বলবেন। বিদগ্ধ মহলে এখন উদ্বাস্তু, পুনর্বাসন নিয়ে অনেক আলোচনা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের শোচনীয় অবস্থা ও সুষ্ঠু পুনর্বাসনের দাবিটিও কি হওয়া উচিত নয়?

বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় প্রাক্তন অধ্যাপক, কৃষ্ণনাথ কলেজ, বহরমপুর

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE