Advertisement
০৫ মে ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: ‘দেহ মোর ভেসে যায়’

দ্বিতীয়ত, যে রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ ঘণ্টা চেতনাহীন থাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই অসুখের নাম, কবির দেহে তার লক্ষণসমূহের কথা উল্লেখ করলেন না প্রবন্ধকার!

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৩৯
Share: Save:

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘মৃত্যুদূতকে পরাস্ত করেছিলেন এক বার’ (রবিবাসরীয়, ৬-৮) সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৭৬ বছর ৪ মাস বয়সে গুরুতর পীড়িত হয়ে রবীন্দ্রনাথ টানা দু’দিনের বেশি সময় অচৈতন্য হয়ে ছিলেন। এই অসুখের অনুপুঙ্খ দীর্ঘ ইতিহাস সমকালীন আনন্দবাজার পত্রিকা-য় দিনের পর দিন (১১-২৩ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ: আনন্দবাজার পত্রিকা-৪ (১৯৯৮) গ্রন্থে এই সব সংবাদ সঙ্কলিত হয়েছে ২৬ পৃষ্ঠা (পৃ ৯-৩৪) ধরে। এর মধ্যে আছে চিকিৎসক নীলরতন সরকার প্রেরিত গোটা বারো মেডিক্যাল ‘বুলেটিন’, আনন্দবাজার পত্রিকার দীর্ঘ সম্পাদকীয়, পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতিবেদন, ১০ সেপ্টেম্বর রাত্রি ৯-১০ টার সময় রবীন্দ্রনাথকে অচৈতন্য অবস্থায় যিনি প্রথম দেখতে পান, সেই সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর নাতিদীর্ঘ পত্রপ্রবন্ধ, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিবৃতি, এবং সর্বোপরি ইউপি ও এপি সংবাদ সংস্থার প্রেরিত খবরাখবর। ওই গ্রন্থ থেকে কবি-জীবনের সেই ভয়ঙ্কর সঙ্কট-মুহূর্তগুলির খুঁটিনাটি আমাদের জানা হয়ে যায়। তার পরেও প্রবন্ধকার দাবি করেছেন, “ছিয়াশি বছর আগের সেই আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন ভয়ঙ্কর দিনগুলোর ইতিহাস আমাদের কাছে আজ অনেকটাই অজানা।” এ কথা বলা যায় কি?

দ্বিতীয়ত, যে রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ ঘণ্টা চেতনাহীন থাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই অসুখের নাম, কবির দেহে তার লক্ষণসমূহের কথা উল্লেখ করলেন না প্রবন্ধকার! অথচ পূর্বোক্ত গ্রন্থে নীলরতন সরকার কর্তৃক কবির যে স্বাস্থ্য বুলেটিনগুলি প্রকাশিত হয়েছে তাতে পাওয়া যায়, “কবি বিসর্প রোগে (ইরিসিপেলাস) কষ্ট পাইতেছেন। অবস্থা উদ্বেগজনক... অপরাহ্ণে শরীরে উত্তাপ খুব বেশি নয়। মুখমণ্ডলের দক্ষিণ দিকে এবং দক্ষিণ কর্ণে বিসর্পের লক্ষণ দেখা দিয়াছে। মূত্রাশয়ের দোষ কমে নাই। রক্তের চাপ মাঝামাঝি।” নীলরতন সরকারের নেতৃত্ব, নির্দেশ ও পরামর্শে নয় দিন ধরে কবির চিকিৎসা করেছিলেন ৮-৯ জন ডাক্তারের একটি দল। প্রবন্ধে তাঁদের নামের উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। এঁদের প্রাণপণ চিকিৎসায় ও নিজের অসাধারণ প্রাণ-ঐশ্বর্যসম্পন্ন জীবনীশক্তির বলে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে শুরু করেন কবি রবিবার (১২ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাত্রি থেকে।

কবির এই অসুস্থতায় গোটা দেশ উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগে উত্তাল হয়েছিল। ১১-১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কবির স্বাস্থ্যের খবর নিতে শান্তিনিকেতনে চিঠিপত্র ও তারবার্তা আসে ৩৬০০টি। এ বিষয়ে প্রবন্ধকার গান্ধীজি ও জওহরলালের নাম উল্লেখ করলেও, সে দলে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বর থেকে ফিরে এসে ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম যে কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লেখেন, সেটি প্রান্তিক কাব্যের ১নং কবিতা, যার উল্লেখ পাই অমিত্রসূদনের লেখায়। মাত্র ১৮টি কবিতার সঙ্কলন প্রান্তিক-এর আরও কয়েকটি কবিতায় মৃত্যুর আঁধার ঘেরা সেই রহস্যময়তার প্রকাশ। “দেখিলাম—অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়/ দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি/ নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ, ...ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ/ অন্তহীন তমিস্রায়।” ৯ সংখ্যক এই কবিতাটি ছাড়াও ‘মৃত্যদূতকে পরাস্ত’ করে রূঢ় বাস্তবে ফিরে আসার কথা আছে ১৭নং কবিতায়— “যেদিন চৈতন্য মোর মুক্তি পেল লুপ্তি গুহা হতে” ইত্যাদি। এই কারণেই প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে অধ্যায়টির নাম দেন ‘প্রান্তিক’।

কাব্যের প্রেক্ষাপট হিসাবে ‘দু’টিমাত্র বাক্যে’ প্রভাতকুমার কবির হতচৈতন্য হওয়ার কথা বলেছেন, প্রবন্ধকারের এই খেদোক্তির কারণ নেই। সকলে জানেন, প্রভাতকুমারের চার খণ্ডের মহাগ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম রবীন্দ্রজীবনী নয়; রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক!

বিশ্বনাথ রায়, কলকাতা-২৯

বঙ্কিমের গান

কৃষ্ণা রায়ের ‘নাটকের গান পছন্দ নয়, তাই সটান প্রেক্ষালয় ত্যাগ’ (রবিবাসরীয়, ৬-৮) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। বঙ্কিমচন্দ্র প্রধানত গদ্যের রূপকার। তবে অন্তরে তিনি ছিলেন কবি। তাঁর অভিনব চেতনাপুষ্ট লেখনী গীতিরসপ্রবাহেও পরিপ্লুত ছিল। বিভিন্ন উপন্যাসেই শুধু নয়, তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধেও রয়েছে সঙ্গীতপ্রিয়তার পরিচয়। কমলাকান্তের দপ্তর-এর ‘কে গায় ঐ’ রচনায় জনৈক পথিকের গীতিধ্বনি তাঁর হৃদয়কে প্রবল ভাবে আলোড়িত করেছিল। আপন মনে গান-করা পথিকের গান শুনে বঙ্কিমচন্দ্রের মনে হয়েছিল, “বহুকাল বিস্মৃত সুখ-স্বপ্নের ন্যায় এ মধুর গীতি কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করিল। এত মধুর লাগিল কেন?... পথিক পথ দিয়া, আপন মনে গায়িতে গায়িতে যাইতেছে। জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি দেখিয়া, তাহার মনের আনন্দ উছলিয়া উঠিয়াছে” (‘কে গায় ঐ’)। আবার ‘আমার দুর্গোৎসব’-এর মাতৃবন্দনার স্তুতি তাঁর হৃদয় কাব্যরসে অনুরণিত। বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের সঙ্গীত বিদ্যায় সুরের বাহুল্য ও অসীম প্রভেদ লক্ষ্য করেছিলেন। দেবী চৌধুরাণী-তে তিনি চন্দ্রালোকিত ত্রিস্রোতার জলে, বজরায় উপবিষ্ট দেবীর বীণাবাদনের মধ্যেও লক্ষ করেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নানা রাগ-রাগিণী। জলে প্রতিবিম্বিত চন্দ্রকিরণের সঙ্গে বীণাধ্বনির উপমা প্রসঙ্গে ঝিঁঝিট, খাম্বাজ থেকে বাগীশ্বরী পর্যন্ত মিঠে, গম্ভীর, জাঁকাল প্রভৃতি রাগিণীর প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি জানতেন, এ সব রাগ-রাগিণীর একটা ভাব-উদ্বোধিকা শক্তি আছে। তবে তিনি মনে করতেন “সংস্কারহীন ব্যক্তি রাগরাগিণী পরিপূর্ণ কালোয়াতি গান শুনিতে চাহে না এবং বহুমিলবিশিষ্ট ইউরোপীয় সঙ্গীত বাঙ্গালীর কাছে অরণ্যে রোদন” (‘সঙ্গীত’)। তিনি এ-ও মনে করতেন যে, শিক্ষা ছাড়া উচ্চশ্রেণির সঙ্গতে সুখানুভব সম্ভব নয়। আসলে সঙ্গীত সম্বন্ধে প্রাচীনদের নিপুণ রসজ্ঞতা তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। নিজে ছিলেন সঙ্গীত রসিক এবং বোদ্ধাও। হয়তো এ কারণেই প্রসাদপুরের কুঠিতে রোহিণী-গোবিন্দলালের (কৃষ্ণকান্তের উইল) একত্রবাসকালে ওস্তাদজির কণ্ঠে রোহিণীর কণ্ঠ মিলিত হলে তাঁর মনে হয়েছিল, “সরুমোটা আওয়াজে সোনালি রূপালি একপ্রকার গীত হইতে লাগিল।” এ-হেন মানুষটি যে কীর্তনওয়ালাকে পেলা দিতে বঙ্গদর্শন-এর তহবিল খালি করে ফেলবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী!

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

আইনের ভাষা

ইদানীং দেখছি, কেন্দ্রীয় স্তরে নতুন বা সংশোধিত আইনের নামকরণ হিন্দি ভাষায় করা হচ্ছে। হিন্দি সংস্করণে আইনটির হিন্দি নাম প্রযুক্ত হলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু আইনের ইংরেজি সংস্করণের ক্ষেত্রেও আইনটির হিন্দি নামটিই ইংরেজি হরফে শিরোনাম হিসাবে লিখিত হচ্ছে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত? যাঁদের হিন্দি তেমন জানা নেই, তাঁরা আইনটি কিসের, সেটাই বুঝে উঠতে পারবেন না। বহু বিদেশি মানুষজন পেশাগত কাজে, ব্যবসায় বা চিকিৎসার জন্য সর্বদা ভারতে আসেন ও থাকেন। এ দেশের আইন তখন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁরাও সহজে কিছু বুঝে উঠতে পারবেন না। নামকরণের উদ্দেশ্য এক কথায় সংক্ষিপ্ত অর্থ ও পরিচয় প্রকাশ করা। নাম যদি সেই উদ্দেশ্য সাধনের প্রতিকূল কাজ করে, তবে নামকরণ বৃথা। সংবিধানের ৩৪৩ (১) অনুচ্ছেদ বলছে, কেন্দ্রীয় স্তরে কার্যালয়গত ভাষা হল হিন্দি, যা দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত। কাজেই ইংরেজি হরফে হিন্দি ভাষায় আইনের নাম লেখা সংবিধান-সম্মত নয়। পক্ষান্তরে, আইনানুসারে ইংরেজিও সরকারি কাজের ভাষা। ইংরেজি ভাষাকে তার অবিমিশ্র, স্বকীয় রূপেই স্বীকার করা যুক্তিযুক্ত। আইনের ইংরেজি পাঠের উপর হিন্দি ভাষার শব্দমালা নাম হিসাবে যুক্ত করার ব্যবস্থা ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট’-এর কোন ধারা অনুযায়ী চালু হয়েছে, জানতে আগ্রহ হয়। প্রশাসনিক ও আইনি ক্ষেত্রে ইংরেজির অবিকৃত ব্যবহার প্রচলিত থাকুক, এটাই কাম্য।

শতদল ভট্টাচার্য, কলকাতা-৯১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE