স্মরণীয় হল না মেহতাব হোসেনের বিদায়ী ম্যাচ। বিদায়বেলাতেও সঙ্গী থাকল হারের যন্ত্রণা। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হল, ম্যাচের শেষে মেহতাবকে মাঠে ফেলে রেখে সতীর্থ খেলোয়াড়েরা উধাও হয়ে গেলেন। দীর্ঘ ১৭ বছর দুই প্রধানের হয়ে তো খেলেইছেন, ভারতীয় দলের হয়েও খেলেছেন যিনি, তাঁর কি এটাই প্রাপ্য ছিল? খেলায় হারজিত সব সময়ই আছে, জিতলে ভাল লাগে আর হারলে খারাপ লাগে, চির কালই। কিন্তু তা বলে একটা খেলায় হেরে গেলেই একটা লোকের অবদান সম্পর্কে বিস্মৃত হতে হবে? তাঁর সামগ্রিক অবদানের অমর্যাদা করতে হবে? তার চেয়ে বড় কথা, এক জন খেলোয়াড়কে হার ও জিত— দুটোকেই প্রায় সমান ভাবে গ্রহণ করার চর্চা করতে হয়। হেরে গিয়েছি বলে সতীর্থের বিশেষ দিনটায় তাঁকে ছেড়ে চলে যাব কেন? ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ কি তা বলে? মনে হয় অন্য দেশে জন্মালে মেহতাবকে এই অবহেলা সহ্য করতে হত না।
সোমা ঘটক
কলকাতা-৯২
বঞ্চনার ইতিহাস
কুমার রাণার ‘শম্বুকের দেশ সমানে...’ (২৩-২) শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য। অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ সহাবস্থান, তাঁরা অহর্নিশ তথাকথিত সভ্যতার রোষানলে পড়েন। শক, হূন, মুঘল, পঠান ভারতের দেহে লীন হয়ে গেলেও, প্রাক-সভ্যতার ভূমিপুত্র আদিবাসী ও বনবাসীরাই বিলীন হয়ে যাচ্ছেন ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে। ভারতের মাটি, বন-জঙ্গল, নদী-নালা-খাল-বিল, পাহাড়-পর্বতের সঙ্গে যাঁদের নাড়ির টান, তাঁরাই আজ আইনের চোখে উদ্বাস্তু।
২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আইন করে বনবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিত করেন। তার পর অনেক সংস্থা বিভিন্ন সময় এই আইনের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলে। দীর্ঘ টালবাহানার পর ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফার্স্ট’ নামের সংস্থার মামলার প্রেক্ষিতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিত্রয়, অরুণ মিশ্র, নবীন সিন্হা ও ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঞ্চ তাঁদের রায়ে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ২১টি রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছেন, আগামী ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে পাট্টার আবেদন খারিজ হওয়া পরিবারগুলোকে উৎখাত করতে হবে অরণ্য থেকে। মামলাকারীদের মতে, দেশ জুড়ে ৪৪ লক্ষ আবেদনের মধ্যে প্রায় ২০.৫ লক্ষ আবেদনই খারিজ হয়ে গিয়েছে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশের ফলে ১০ লক্ষের বেশি আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসী পরিবারের উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খবরে প্রকাশ, তিন প্রজন্ম বসবাসের যথেষ্ট প্রমাণ না থাকার কারণে এই সমস্ত বনবাসীকে বন থেকে বিতাড়িত হতে হবে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই আছে প্রায় ৮৬ হাজার পরিবার। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, বন ধ্বংস করে কৃষি, গ্রাম, শহর গড়ে ওঠে। ডি ডি কৌশাম্বী বা রোমিলা থাপারের মতে, আর্যসভ্যতার শুরুতেই অরণ্য ও গ্রামের বৈরিতা লক্ষ করা যায়। আঠারো শতকের শেষ থেকে স্বাধীনতার পর ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জঙ্গল ধ্বংস করে অরণ্যবাসীকে উৎখাত করে রাজস্ব আদায়ের করুণ ইতিহাসের কাহিনি। ১৮৭৮ সালে অরণ্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুকৌশলে বনবাসী জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা। জমি ব্রিটিশ সরকারের, অন্য কারও অধিকার নেই। বিস্তীর্ণ অরণ্য রাজস্বের অন্যতম বড় উৎস, তাই ইংরেজ শাসকরা অরণ্যবাসীদের বঞ্চিত করে জঙ্গল মহলের ইজারা ন্যস্ত করলেন জমিদার ও ঠিকাদারদের হাতে। সিধু-কানু-বিরসা এবং বঞ্চিত অরণ্যবাসীরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। সিংভূম-ছোটনাগপুরে মুন্ডা, গাঢ়য়াল-কুমায়ুন ও পঞ্জাবের পাহাড়িয়া, মধ্যপ্রদেশের বাইগারা বা রাঢ়বঙ্গের সাঁওতাল-কুর্মিরা আন্দোলনে শামিল হন। ১৮৯৫ সালে ‘উলগুলান’ বা উপজাতি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে ১৭৮৯-১৭৯৫ সালে তামাড় পরগনার বিদ্রোহ, ১৮৫৮-১৮৯২ পর্যন্ত সর্দারদের মুলকুই লড়াই এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সাঁওতাল হুল বিদ্রোহ জঙ্গলের অধিকারের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া হয়েছে কোল বিদ্রোহ, সিধু-কানুর হুল (১৮৫৫-৫৭), খেরোয়ারের বিদ্রোহ। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত খুটকাট্টি গ্রাম, দামিনই-কো গ্রাম থেকে উৎখাত হওয়ার বিরুদ্ধে মুন্ডারা বার বার লড়েছেন। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ধামসা-মাদলের বিদ্রোহের আগুন ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গল মহলে। ইংরেজদের আধুনিক বন্দুকের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে তির-ধনুক নিয়ে আদিবাসীদের লড়াই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অসম যুদ্ধে আদিবাসীরা পরাজিত হন। ফাঁসি হয় বিরসা মুন্ডার।
আধুনিক অরণ্য-দিশায় দেশের অনেক জায়গায় দামি উন্নত কাঠের বাগিচাবন তৈরি হল, বাকি অংশে তৈরি হল ন্যাশনাল পার্ক, অভয়ারণ্য। কিন্তু অরণ্য যে বনবাসী আদিবাসী মানুষদের ঐতিহাসিক সামাজিক পরিচয় ও জীবন জীবিকার আধার ছিল, তা গণ্য হল না।
১৯৫২ সালে অরণ্য নীতি অনুযায়ী (National Forest Policy) বনবাসীদের জঙ্গলের অধিকারটি ঊহ্যই থেকে যায়। চলতে থাকে বিপরীতমুখী নীতি, এক দিকে অবাধে বৃক্ষছেদন অন্য দিকে বৃক্ষভূমি (Tree lands) স্থাপনের মহাযজ্ঞ শুরু হয়। ১৯৫৩ সালে জমিদার, ভূস্বামী ও রাজ্যগুলির অধীনে থাকা বনাঞ্চল সরকারি বনদফতরের আওতাভুক্ত হয়। অরণ্য ধ্বংসকারী, অনুপ্রবেশকারী, কাঠচোর অপবাদে বনবাসীদের উপর চলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন। এমনকি তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থানে সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জঙ্গলবাসীরা গর্জে ওঠেন। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার দাবিপত্র পেশ হয়। লাগাতার আন্দোলনের চাপে ঐতিহাসিক বিরসা লড়াইয়ের প্রায় ১১২ বছর পর ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘বনবাসী তফসিলি জনজাতি এবং অন্য পরম্পরাগত বনবাসীদের বনাধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬’, লোকসভায় পাশ হয়ে সরকারি ভাবে বিজ্ঞাপিত হয়। এই আইনের প্রস্তাবনায় সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে, আদিবাসী ও অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ‘ঐতিহাসিক অন্যায়’-এর শিকার।
বলা বাহুল্য, ‘পাট্টাবিলি’র ইতিহাস বেশির ভাগই রাজনৈতিক বা ভোটকেন্দ্রিক। অভিযোগ, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য, খনি ব্যবসার জন্য বেসরকারি সংস্থার হাতে জমি, অরণ্য হস্তান্তরিত হচ্ছে।
দীপক সাহা
করিমপুর, নদিয়া
ইনসানিয়াত
দেশ জুড়ে চলছে সব পাকিস্তানি এবং কিছু ভারতীয় (পড়ুন কাশ্মীরি মুসলমান)-দের মুন্ডুপাত; তীক্ষ্ণ ঘৃণার প্রদর্শন আর বাগে পেলে হাতের সুখ করে নেওয়ার তীব্র সুখ। রাজ্যপালের মতো সম্মানিত ব্যক্তি কাশ্মীরিদের বয়কট করার ডাক দিচ্ছেন। প্রশাসনের অবস্থা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো। এই জনরোষ সামনের নির্বাচন জেতানোর সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। ধুলোয় যাক মানবতা; সংসদীয় গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক। এই পটভূমিতে, আটকে পড়া পর্যটকদের প্রতি যে আচরণ কাশ্মীরি মুসলমানরা দেখাচ্ছেন তা আভূমি কুর্নিশের যোগ্য। একটিও অন্য প্রদেশের মানুষকে এ পর্যন্ত অত্যাচার দূরে থাক, অবহেলাও সইতে হয়নি। উড়ান বন্ধ, তুষারাবৃত সড়ক। খবরে প্রকাশ, হোটেল মালিকরা বিনা খরচে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন; স্থানীয় মানুষেরা সম্পূর্ণ অপরিচিতদের জন্য খুলে দিয়েছেন ঘরের দরজা। আমরা তথাকথিত শিক্ষিত, বিবেকবানরা যা করার কথা ভাবতেও পারি না, সেই কাজ ওঁরা করে দেখিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’লাইন লিখে নয়, মোমবাতি নিয়ে মিছিল করে নয়, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচিয়ে নয়— করে দেখিয়েছেন ‘ইনসানিয়াত’ কাকে বলে।
দেবাশিস মিত্র
কলকাতা-৭০
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy