Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: বিপ্লবের কাহিনি

এই নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আগে মার্চ মাসে এবং ঠিক তার পরেই ১৯২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে, জাপানে প্রবল ভূমিকম্প হয়। সমুদ্রের ঢেউ ৪০ ফুট উঁচু সুনামি হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ মারা যান। ৪০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হন, ধরে নেওয়া হয় তাঁরা মারা গিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০০

‘বাঙালি বিপ্লবীর জাপানি বউ’ (রবিবাসরীয়, ৮-৭) প্রসঙ্গে কিছু সংযোজন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই শ্রীমতী তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারী বসুর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৯২০-র ১৩ অগস্ট জন্ম নেয় পুত্র মাশাহিদে, যাঁর ভারতীয় নাম ভারতচন্দ্র। ১৯২২-এর ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয় মেয়ে তেৎসুকো-র। ১৯২৩ সালের ২ জুলাই জাপানের নাগরিকত্ব পান রাসবিহারী।

এই নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আগে মার্চ মাসে এবং ঠিক তার পরেই ১৯২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে, জাপানে প্রবল ভূমিকম্প হয়। সমুদ্রের ঢেউ ৪০ ফুট উঁচু সুনামি হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ মারা যান। ৪০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হন, ধরে নেওয়া হয় তাঁরা মারা গিয়েছেন। এ ছাড়াও ৪৪ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। রাসবিহারীর আশ্রয়স্থলটি ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ে রাসবিহারী বসু স্ত্রী, আড়াই বছরের পুত্র এবং আট মাসের কন্যাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন। এ ছাড়া ওই সময়ও তাঁকে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হচ্ছিল।

এই দুর্দিনে তিনি বাংলার বিপ্লবী চন্দননগরের শ্রীশচন্দ্র ঘোষকে ১,০০০ টাকা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন।

অগ্নিযুগের শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র রাসবিহারীর মতো চন্দননগরের ডুপ্লে স্কুলে পড়েছেন। তাঁর সঙ্গে রাসবিহারীর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। রাসবিহারীর পিতা বিনোদবিহারী এবং শ্রীশচন্দ্রের কাকা বামাচরণ শৈশবে খেলার সঙ্গী ছিলেন এবং যৌবনে উভয়ে একসঙ্গে সরকারি ছাপাখানায় চাকরি করেছেন। পারালিবিঘাটি গ্রামের নবীনচন্দ্র সিংহের দুই কন্যাকে দু’জনে বিবাহ করেছেন এবং চন্দননগরে বাড়ি করে পাশাপাশি বসবাস করছিলেন। অর্থাৎ রাসবিহারীর মা ভুবনেশ্বরী দেবী ও শ্রীশচন্দ্রের কাকিমা ব্রজেশ্বরী দেবী ছিলেন আপন সহোদরা বোন। শ্রীশচন্দ্র শৈশবে পিতৃহীন হওয়ায় পিতৃব্য বামাচরণ ঘোষের কাছে চন্দননগরের ফটকগোড়া অঞ্চলে রাসবিহারীদের পাশের বাড়িতে প্রতিপালিত হয়েছিলেন।

শ্রীশচন্দ্র ভেবেছিলেন, দিল্লি-লাহৌর-বারাণসী ষড়যন্ত্রের নায়ক রাসবিহারীর বিপদের কথা শুনলে ভারতীয়রা নিশ্চয় অর্থসাহায্য করবেন। রাসবিহারীর নামডাক আছে, সুতরাং তাঁর নাম মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করবে। তাই ব্যক্তির পিছনে না ছুটে, তিনি রাসবিহারীর পত্রটি সংবাদপত্রে ছাপিয়ে প্রকাশ করে দেন। কিন্তু দেখা গেল, কাগজে রাসবিহারীর চিঠি বা ওই সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর মনিঅর্ডারে তাঁর অর্থসাহায্য জুটল সর্বমোট ১৬ টাকা। শ্রীশচন্দ্র তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় এবং বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

ও দিকে শ্রীশচন্দ্র তাঁর ব্যক্তিগত ভাবে টাকা চাওয়ার বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রকাশ করায় রাসবিহারী বিরক্ত হয়েছিলেন। শ্রীশকে তিনি পত্রে লেখেন, ‘‘আমার ভিতরটা কি কেউ দেখছ, দেশের জন্য যে সবটা পেতে দিয়ে বসে আছি সেটা কি কেউ দেখছ, তারা বোধ হয় দেখে, আমি বোমা আর রিভলবার, আমি ষড়যন্ত্রের একটা মস্ত খেলোয়াড়। তারা আমায় জানবে কেন? ঘুম না ভাঙলে তারা আমায় জানবে কেন? তাদের কাছে টাকা চাওয়া কেন?’’

তার পর অবশ্য শ্রীশকে সান্ত্বনা দিয়ে লিখেন, ‘‘আচ্ছা লড়ে যাব, তোমরা অত ভয় খেয়ো না।’’

শ্রীশচন্দ্র সংবাদ পেলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের জাপান সাহায্য তহবিলের সংগৃহীত অর্থ মোট ৬২১ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তখনও শ্রীশচন্দ্রের মনে হল, এক হাজার তো হল না। তাই আবার তিনি মদনমোহন মালবীয় এবং লালা লাজপত রাইকে চিঠি লিখলেন। কিন্তু সে চিঠিতেও কোনও কাজ হল না। শেষে শ্রীশ রাসবিহারীর চিঠি পেয়ে তাঁর জন্য অর্থসংগ্রহের কাজ ত্যাগ করলেন।

ব্রিটিশের শত্রু রাসবিহারীকে ভারতীয়রা কেন সাহায্য করেনি? জাপানে রাসবিহারীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ প্রশাসন আইনত কোনও ব্যবস্থা করতে পারেনি। কিন্তু বেআইনি ভাবে সেই চেষ্টায় তারা সফল হয়েছিল ভারতের অভ্যন্তরে। তাই রাসবিহারীকে অর্থসাহায্য করার সাহস ও সামর্থ্য থাকলেও ভারতে প্রায় কেউই তা করে দেখাতে পারেননি। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা রাসবিহারী সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবে লিখছিল, তিনি বলশেভিক-আফগান কত কী ষড়যন্ত্রই না করে চলেছেন।

ব্রিটিশের শত্রু রাসবিহারী নিশ্চয়। কিন্তু কী কারণে? ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কারণে। আজ স্বাধীনতার এত দিন পরেও দেখি স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের মূল্যায়ন হয় না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, রাসবিহারী বসুর সঙ্গে শ্রীশচন্দ্র ঘোষের (১৮৮৭-১৯৪১) নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, রাসবিহারী তাঁকে চিঠিপত্র ও বই পাঠাতেন। নানা আশাভঙ্গের কারণে, দারিদ্র ও মানসিক পীড়নে শ্রীশচন্দ্র পরবর্তী কালে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। রাসবিহারীর পাঠানো বই বুকে চেপে ধরে তাঁকে প্রকাশ্যে খেপার মতো ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন চন্দননগরের বহু মানুষ। শেষে ১৯৪১ সালের ২ মে অগ্নিযুগের এই অমূল্যনিধি আফিম খেয়ে আত্মহনন করেন। আমরা তাঁকে এই পথেই ঠেলে দিয়েছিলাম।

শিবানন্দ পাল

খাল বিল মাঠ, পূর্ব বর্ধমান

সবাই অসহিষ্ণু

সোনালী দত্তের ‘আমাদের শুনতে দিন’ (১৩-২) লেখাটি ইংরেজিতে যাকে naive বা অতিসরল বলে, অনেকটা সে রকম। নিমন্ত্রিত হয়ে কোনও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করা সমীচীন নয়, সাধারণ ভদ্রতার মধ্যেও পড়ে না। অমোল পালেকরের যদি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করার অভিপ্রায় ছিল, তিনি অন্য কোনও মঞ্চ ব্যবহার করলে পারতেন। লেখাটি পড়ে মনে হয়, শাসক দলই শুধু ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছে আর অন্যরা মুখ বুজে ‘গুমরে মরছেন’। অন্যরাও যে কম ‘অসহিষ্ণু’ বা ‘হিংস্র’ নন তার প্রমাণ তো দৈনিক সংবাদপত্রে ও দূরদর্শনে হরবখত দেখা যাচ্ছে।

লেখিকার পর্যবেক্ষণ: ‘‘হিংস্রতার সংস্কৃতি হঠাৎই যেন দেশ জুড়ে ফুঁসে উঠেছে।’’ আসলে হিংসা বা অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি আবহমান কাল ধরেই মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে। উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে তীব্র হিংসা, দ্বেষ ও পরিণামে মৃত্যুর মিছিল ও রক্তের প্লাবন। কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের মধ্যে হিংসা ও অসহিষ্ণুতা গোড়া থেকেই এমন তীব্র ছিল যে শাসক কংগ্রেসিরা কমিউনিস্টদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সে সময় কমিউনিস্টদের অনেককে শাসকের অত্যাচার এড়িয়ে অনেক দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়। কংগ্রেসের পর জ্যোতি বসুর কমিউনিস্ট পার্টি অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধলেও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্টদের অসহযোগিতায় অজয়বাবু মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে বামফ্রন্ট সরকার কংগ্রেস ও মাওবাদীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছে। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন তৃণমূলও বিজেপিকে দাবিয়ে রাখার জন্যে নানা রকম কূট কৌশল ছাড়াও হিংস্র আক্রমণের পথও বেছে নিয়েছে, তার প্রমাণ গত পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গিয়েছে। এই অসহিষ্ণুতা সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছে।

‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘বিদ্বজ্জনেরা’ অসহিষ্ণুতা বিষয়ে কথা বলে বেড়াচ্ছেন। অসহিষ্ণু প্রত্যেকেই— নিজের মতবিরোধী অন্য কাউকে সহ্য করা মানুষের স্বভাবই নয়। আর্যেরা অনার্যদের সহ্য করেনি, অনার্যরা আর্যদের। হিন্দুরা মুসলমানদের সহ্য করতে পারেনি, মুসলমানেরা হিন্দুদের। উঁচু জাত নিচু জাতের লোকেদের সহ্য করেনি, নিচু জাতও উঁচু জাতের লোকেদের সহ্য করতে পারেনি। শিক্ষিতরা অশিক্ষিতদের উপহাস করেছে, অশিক্ষিতরা শিক্ষিতদের ঈর্ষা করেছে। ধনী দরিদ্র মানুষদের পায়ের তলায় পিষেছে, নির্ধন ধনীর অত্যাচারকে কখনও ক্ষমা করেনি। যাদের অনেক আছে তারা সাধারণ মানুষ ও সর্বহারাদের প্রতিপত্তি দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ পেয়েছে। সর্বহারারা তাতে কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু তাদের মনের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন কখনও নেভেনি।

মনোজ ঘোষ

কলকাতা-৬১

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

Rash Behari Bose Political Leader Toshiko Bose রাসবিহারী বসু
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy