Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: সেই নক্ষত্রেরা

পটারির শ্রমিক বস্তিতে আগুন দেওয়া হয়— ইউনিয়ন অফিস পোড়ানো হয়। পুলিশ ও গুন্ডার অত্যাচার সে দিন চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে।’’

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০০:১৩
Share: Save:

শিলাদিত্য সেনের ‘যেন এক অলীক ভুবন’ (৩১-৩) পাঠের প্রতিক্রিয়ায় এই চিঠি। জানি না, আজ যে সমস্ত তরুণ নাট্যশিল্পী এই বাংলায় প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন, তাঁদের কত জন জানেন পূর্বের ওই অভিনেত্রীর দল— তৃপ্তি মিত্র (ছবিতে) শোভা সেন রেবা রায়চৌধুরী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধনা রায়চৌধুরী প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায় দীনা গাঁধী গীতা সেন ঊষা দত্ত চিত্রা সেন-সহ এক ঝাঁক অভিনেত্রী কী ভাবে শিল্প এবং জীবনকে দেখেছিলেন। ‘‘থিয়েটার করতে আসাটা তখন কিন্তু ছিল— দেশের জন্য কোনো একটা কাজ করছি এই অনুভূতি থেকে। ... ফেমিনের কারণে তখন রিলিফ-কিচেনের জন্য টাকা তুলি, ফার্স্ট এড শিখি গ্রাম ছেড়ে আসা কৃষক (তখন অবশ্য তারা ফুটপাথের ডেস্টিচুট)— তাদের খাওয়াই সকলে মিলে। কখনো অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হয়, কখনো বা চলার পথে মৃতদেহ দেখতে হয়।’’— অভিজ্ঞতা তৃপ্তি মিত্রের। রেবা রায়চৌধুরী লিখছেন, ‘‘আমরা যারা কেন্দ্রীয় ব্যালে ট্রুপের সদস্য হয়েছিলাম তারা প্রায় সকলেই গণ আন্দোলনের কর্মী ছিলাম। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং মন্বন্তরের প্রতিরোধে আমরা কলেজ ছেড়েছিলাম, জীবন উৎসর্গ করেছিলাম।’’ সাধনা রায়চৌধুরীর শুরু, ‘‘খুবই ইচ্ছে ছিল এম এ পড়ার, কিন্তু মাসতুতো ভাই চিন্মোহন সেহানবীশ পার্টির কাজে লাগিয়ে দিলেন। পড়া আর হল না। তখন পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট চালু ছিল। তার কাজ আমাদের করতে হবে।’’ এই সব অভিনেত্রীদের হাতে ধরা ছিল আদর্শের কেতন। পরবর্তী কালে যে আদর্শকে মর্যাদা দিতে পারেনি গণনাট্য সঙ্ঘ তথা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এই সময়ের শিল্পী ও কর্মীদের নিয়ে আজও পাওয়া যায় না গবেষণাভিত্তিক রচনা। কত জন আজ মনে রেখেছেন বা জানেন, স্বাধীন দেশের পুলিশ ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল বৌবাজার স্ট্রিট অঞ্চলে এক মহিলা মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল লতিকা সেন অমিয়া দত্ত গীতা সরকার প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায় যমুনা দাসকে!

আর একটি ঘটনার কথা জানাচ্ছেন জগৎ বসু, ‘‘১৯৪৮ সালের ৫ই জানুয়ারি শুরু হয় সারা কলকাতা জুড়ে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট রায়ট। পটারির শ্রমিক বস্তিতে আগুন দেওয়া হয়— ইউনিয়ন অফিস পোড়ানো হয়। পুলিশ ও গুন্ডার অত্যাচার সে দিন চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে।’’ এই সময়ের কিছু পরে, শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘বহুরূপী’ অভিনয় করছে ‘দশচক্র’ নাটকটি। ধর্মতলায় এক দিন তাঁর দেখা হল কমিউনিস্ট নেতা বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বঙ্কিমবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কী নাটক করছেন এখন? তখন বিধানসভায় হাতে গোনা কমিউনিস্ট সদস্য। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় প্রচণ্ড প্রতাপে শাসন করছেন। শম্ভু মিত্র উত্তর দিলেন, আপনারা তো বিধানসভায় মাত্র কয়েক জন মিলে ব্রুট মেজরিটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছেন। আমার নাটকটাও কিন্তু সেই ব্রুট মেজরিটির বিরুদ্ধে এক আদর্শবান মানুষের নাটক। এর পরেও শম্ভু মিত্র ছিলেন কমিউনিস্টদের কাছে বিরুদ্ধবাদী!

গত ৩৪ বছরের কথা নয়— ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই তো এঁরা উপেক্ষা করতে শুরু করেছিলেন সেই সব কর্মীকে, যাঁরা নিজেদের জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন আদর্শের জন্য। শুধু অভিনেতার কথা নয়, কে মনে রেখেছে হাওড়ার গ্রামে গ্রামে সারা জীবন কাজ করে যাওয়া মদন দাস ওরফে মদন মাস্টারকে? তাঁর মৃত্যুর কত দিন পরে সংবাদ পৌঁছেছে পাঁচ তলার নেতাদের কাছে? কে জানে, হাওড়ার সমর মুখোপাধ্যায় (বুয়া)-র কথা? যাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি, মেরে হাত-পা ভেঙে ঢুকিয়ে দিয়েছে খাটা পায়খানার গামলায়! সেই পঙ্গু বুয়ার শেষ জীবনটা কী ভাবে কেটেছে! কে জানে শ্রমিক লড়াইয়ে দালালদের হাতে নৃপেন চক্রবর্তীর দাদা কৃষ্ণ চক্রবর্তীর ওপর হিংস্র আক্রমণের কথা! একটি মালাও আসেনি পার্টি অথবা সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদাতিক কবি’র মৃত্যুর পর! কারণ তিনি বিপথ-পথিক!

এখানে একটি বিপদের কথাও বলা দরকার। কিছু শিল্পী এখন সিপিআইএম-এর ব্যর্থতাকে আক্রমণ করে বেশ রসিকতা-সহ শিল্পচর্চা করছেন। তিনটি ভাগের কথা বলতে হয়। প্রথম: যাঁরা সিপিআইএম-এর ব্যর্থতাকেই কমিউনিজ়মের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। দ্বিতীয় অংশ: বামফ্রন্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ থেকে নানান সুযোগ-সুবিধে গ্রহণের পর, হঠাৎ মত বদল করে আজকের উচ্চতর বাম সরকার(!) প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করছেন। আর তৃতীয়, যাঁরা প্রকৃত অর্থে আজও কমিউনিজ়মে বিশ্বাস রাখতে চান, কিন্তু এই পার্টির ব্যর্থতা নিয়ে আত্মসমালোচনা করেন। তাঁরা বোধ হয় আর এক বার ভেবে দেখলে ভাল করবেন, এই ধরনের হালকা আক্রমণের মধ্য দিয়ে মানুষ কিন্তু বাম দর্শনের প্রতি বিরূপ হচ্ছেন। নতুন ভাবে এই দর্শন সম্পর্কে ভাবনা শুরু করছেন না।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিন্তু নতুন ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কমিউনিজ়মে মার্ক্সবাদ শেষ কথা নয়। মার্ক্স, রোজ়া লুক্সেমবার্গ, ট্রটস্কি, লেনিন, গ্রামশি, সব বিষয়ে গবেষণা চলছে। তাই সিপিআইএম-কে গ্রাহ্য করবার কারণ নেই।

সুরথচন্দ্র মজুমদার শিবপুর, হাওড়া

ভোটের গল্প

প্রায় দুই দশকের বেশি সরকারি কর্মচারী হিসেবে ভোটের কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে কিছু অভিজ্ঞতা শোনাই। শীতকালে ভোট, ভোরবেলা। ভোটকেন্দ্রের দরজা খুলে বাইরে আসতেই আবছা আলোয় দেখি, সামনের উঠানে মলিন বেশে এক জন দাঁড়িয়ে আছেন। মাঠে যাবেন চাষের কাজে, প্রথমেই ভোটটা দিয়ে যেতে চান। এটাই নাকি বরাবরের অভ্যাস। যদিও ভোট শুরু হতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি।

চাকরি জীবনের প্রথম দিককার ভোট। অনেক নদী-নালা, খালবিল, বাঁশবন পেরিয়ে বাসে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক যাওয়ার পর পৌঁছই। চতুর্দিকে ধু-ধু মাঠ, মাঝে ভোটকেন্দ্র। মাঠের পর থেকেই চাষের খেত শুরু। নতুন জামাই প্রথম শ্বশুরবাড়ি এলে যেমন হয়, গ্রাম উজাড় করে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ভোটকেন্দ্রটি একটি জুনিয়র প্রাথমিক বিদ্যালয়। দু’টি মাত্র ঘর। গ্রামের এক ব্যক্তির অনুরোধ মতো কাছেই তাঁর বাড়ির বাথরুমে যাওয়ার জন্য সবা‌ই প্রস্তুতি নিচ্ছি, কিছু ব্যক্তি ওই বাড়ির বাথরুম ব্যবহারে আপত্তি জানালেন। কারণ, উনি একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। কোনও নির্দলের বাথরুম না পাওয়ায়, অন্ধকারের অপেক্ষা করতে হল, চাষের খেতই বাথরুম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

আর এক ভোট। ভোটার কার্ড না থাকায়, পাড়ায় এক মহিলাকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। কাছাকাছি হোটেল বা দোকান নেই, তাই এক বাড়িতে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। খাওয়ার মাঝপথে, হঠাৎই ওই বাড়ির এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ‘‘এই তোমরা কেমন লোক গা, আমার বৌমারে ভোট দিতে দিলা না!’’

আর একটি ভোট, অনেক রাত অবধি আমাদের কাগজপত্তরের কাজ চলছে। প্রায় সারা রাত ধরেই প্রহরে প্রহরে এক দল লোক খোল-করতাল বাজিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করছে, এবং সেটা ওই বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই। রাত প্রায় দুটো নাগাদ আমাদের অনুমতি নিয়ে ওই দলের দু’জন ব্যক্তি আমাদের চারটে করে বাতাসা হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। এক সহকর্মী বললেন, বুঝলেন স্যর, এটাও এক ধরনের প্রচার।

বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া এক ভোটকেন্দ্র। ভোট গ্রহণ শেষ হতে আর অল্প কিছু সময় বাকি। হন্তদন্ত হয়ে পাঁচ-ছ’জন ভোটার হাজির। তাঁদের ভোটার কার্ডের অবস্থা অত্যন্ত জরাজীর্ণ। দুই সীমান্তের মাঝে ওঁদের চাষের জমি পড়েছে। প্রত্যহ চাষের কাজে যাওয়ার সময় ভোটার কার্ড বিএসএফ-এর কাছে জমা দিতে হয়।

ভোট বিষয়ে অন্য রকম অভিজ্ঞতাও আছে। সিকিম বেড়াতে গিয়েছি। গাড়ির চালক হঠাৎ গাড়িটাকে রাস্তার এক পাশে রেখে তরতর করে লাগোয়া পাহাড়ে উঠে গেলেন। অল্প কিছু সময় পরে নেমে এলেন। সে দিন সিকিমের পঞ্চায়েত ভোট, উনি ভোট দিয়ে এলেন।

দেবাশীষ ভট্টাচার্য ভাটপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tripti Mitra Communism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE