ফাইল চিত্র
‘দূষণ কাটাতে শহরে ফিরুক ট্রাম, উঠল দাবি’ (২০-৪) শীর্ষক সংবাদের প্রেক্ষিতে এই পত্র। আমাদের দুর্ভাগ্য, বায়ুদূষণের নিরিখে দেশের তাবড় মহানগরীর মধ্যে কলকাতার স্থান অনেক উপরে। ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, দেশের সব ক’টি মেগাসিটির মধ্যে দিল্লি ও কলকাতাতেই নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৪০ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়াও ধোঁয়া-দূষণের হটস্পট হল কলকাতা। ইতিপূর্বে ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’-এর রিপোর্টেও বলা হয়েছিল, গত পাঁচ বছর ধরে বায়ু দূষণ সূচকের স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়ানোর জন্য সারা দেশের যে ১০২টি শহরকে ‘নন অ্যাটেনমেন্ট সিটি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের অন্যতম হল কলকাতা।
তদুপরি, ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’-এ ২০২৪ সালের মধ্যে সারা দেশে দূষণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা ২০-৩০ শতাংশ রাখা হলেও, এখন কলকাতার যা পরিস্থিতি, তাতে তার দূষণ কমাতে হবে ৪৮-৪৯ শতাংশ। আর এক ধাপ এগিয়ে ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (দিল্লি)’-র রিপোর্টে, কলকাতার দূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে পুরনো যানবাহনের ধোঁয়া ছাড়াও জৈব জ্বালানিকে দায়ী করা হয়েছে। তাই কলকাতার বাতাসে বিষের পরিমাণ হ্রাস করার স্বার্থে, পরিবেশবান্ধব ট্রামের পুনরুজ্জীবনের দাবি করেছেন অনেকে।
ট্রাম কোম্পানির ভাঁড়ারে ২৫২টি ট্রাম থাকলেও, বর্তমানে ৭টি রুটে প্রতি দিন চলে ৩২টি ট্রাম। অথচ প্রায় দু’দশক আগেও কলকাতা ট্রামওয়েজ় কোম্পানিতে থাকা ৩১৯টি ট্রামের মধ্যে দৈনিক চলাচলকারী ১৬০টি ট্রাম গড়ে দেড় লক্ষ যাত্রী বহন করত। উন্নত ইউরোপ ও আমেরিকার ৩৫০টির অধিক শহরে ট্রাম চালু রয়েছে, আরও ৭০টি শহরে তা চালু করার তোড়জোড় চলছে।
তবু ‘শ্লথগতি’, ‘যানজটের কারণ’ ও ‘চালাতে লোকসান হয়’— এই তিনটি কারণে কলকাতার বেশ কিছু রুটে ট্রাম তুলে দিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে রাস্তায় বাস নামায় ট্রাম সংস্থা। তা ছাড়াও বেশ কয়েক মাস ধরে উত্তর কলকাতার সঙ্গে বিবাদী বাগ সংযোগকারী শ্যামবাজার, বিধাননগর ও রাজাবাজার ডিপো থেকে আসা ট্রামগুলি বন্ধ রয়েছে। লাভ কম হওয়া অথবা যাত্রীর অভাব যার কারণ নয়। মেট্রোর কাজের জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ নিগম।
একই কারণে গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, খিদিরপুর ও পার্ক সার্কাস ডিপো থেকে বিবাদী বাগে আসা ট্রামগুলি মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মতলায়। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার যাত্রীরা ট্রামে চড়ে আসতে পারছেন না বিবাদী বাগে। মেট্রো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বন্ধ রুটের বিকল্প পথ খোঁজার আশ্বাস দিয়েছিল এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রাজ্য পরিবহণ নিগম। এখনও সে কাজ এক চুলও না এগোনোয়, দেশের মধ্যে একমাত্র চলা হেরিটেজ তালিকাভুক্ত ট্রাম তুলে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
ট্রাম কোনও মতেই শ্লথগতি যান নয়। রাস্তা ফাঁকা থাকলে এর গতি যে প্রায় বাসের সমান, ময়দান অঞ্চলে ট্রামে চড়লে তার নমুনা মেলে। আসলে প্রায় সময়েই লাইন ঠিকঠাক না থাকায় এবং লাইন জুড়ে ট্যাক্সি অটো, ঠেলা, বাইক, বাস মিনিবাস ইত্যাদি যান পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকায়, ট্রাম সামনে এগোতে পারে না। এর দায় ট্রামের নয়। লাইন মেরামত না করে দিনের পর দিন ভাঙাচোরা অবস্থায় ফেলে রাখায় বর্ষায় ট্রামলাইনের পাত সরে গিয়ে পিচ উঠে পাথর বেরিয়ে পড়ে। তা ছাড়াও বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দরুন সারিবদ্ধ ট্রাম থমকে থাকে।
সরকারি বাসের জন্য রাজ্য সরকারকে যেখানে বছরে ১০০ কোটির বেশি টাকা ভর্তুকি গুনতে হয়, সেখানে মাত্র কয়েক কোটি টাকা ঘাটতি পূরণের জন্য ট্রাম তুলে দিতে হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
ডিজ়েল, পেট্রলের মূ্ল্যবান তৈলভাণ্ডার আগামী অর্ধশতক পরে বিশ্ব থেকে নিঃশেষিত হয়ে যাবে, আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। ট্রাম চালাতে এক ফোঁটা জ্বালানিরও দরকার হয় না। বিদ্যুৎচালিত এই যানটি বায়ুদূষণের হাত থেকেও জনজীবনকে রক্ষা করে। এ সব কারণেই বেশ কয়েক বছর আগে লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, দিল্লি, মুম্বই ও চেন্নাই থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া হলেও, ম্যানচেস্টার, ব্রাসেলস, আমস্টার্ডাম সমেত ইউরোপের বহু শহরে নতুন করে ট্রাম চালু হয়েছে। মনে রাখা ভাল, একটি ট্রাম দু’টি সরকারি বাসের মিলিত যাত্রী সংখ্যার অধিক যাত্রী বহন করে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের ইনস্টিটিউট অব আরবান ট্রান্সপোর্ট ও বণিকসভা ফিকি-র যৌথ সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বর্তমানে মেট্রো রেল চলাচলে অত্যধিক ব্যয়, আশানুরূপ যাত্রীর অভাব এবং এই ব্যবসা অলাভজনক হওয়ার দরুন, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় দেশের মাঝারি মানের শহরগুলিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নবসাজে ট্রাম চালু করা যেতে পারে। কারণ, এক কিলোমিটার মেট্রো চালু করার খরচ যেখানে ৩৫০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা, সেখানে একই ক্ষেত্রে ট্রামের জন্য খরচ হবে মাত্র ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা।
ওই সুপরামর্শে সায় দিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক মনে করেছিল, ফরাসি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ট্রামের চাকায় চাকায় রবার বেল্ট পরিয়ে, তার ঘটাং ঘটাং শব্দ বন্ধ করে, কলকাতার ট্রামের উন্নততর পুনরুজ্জীবন ঘটানো সম্ভব।
একই বছরে ফ্রান্সের সেনেট সদস্য তথা স্ট্রাসবুর্গ-এর মেয়র রোলাঁ রিস, দিল্লিতে ফিকি ও ফরাসি দূতাবাস আয়োজিত ‘নেক্সট জেনারেশন ট্রামওয়েজ় সলিউশন’ শীর্ষক আলোচনাসভায় বলেছিলেন, ‘‘লোকে বলে রাস্তায় ট্রামলাইন থাকলে গাড়ির গতি কমে যাবে। কিন্তু তাদের বোঝাতে হবে, গাড়ির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক সময় রাস্তায় কোনও ফাঁকা জায়গা থাকবে না। ট্রামের মতো পরিবহণ ব্যবস্থার কথা ভাবতেই হবে।’’
মানস কুমার রায়চৌধুরী
কলকাতা-২৬
কারণগুলি
আমি প্রবীণ নাগরিক। বর্তমানে দেশপ্রিয় পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে থাকি। বেশ কিছু বছর বন্ধ থাকার পর ট্রাম চালু হয়েছে টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ রুটে। কিন্তু যখন লজ্ঝড়ে এই ট্রামগুলো চলে, মনে হয় মালগাড়ি যাচ্ছে। কারণ: ১) বেশির ভাগ ট্রাম বেশ পুরনো, তাই চলার সময় দারুণ কাঁপে। ২) কংক্রিটের ট্র্যাকের ওপর ট্রাম চলে বলে প্রচণ্ড শব্দ হয়।
সরকার ট্রাম চালানোর দিকে মন দিতে চায় না, তার কারণ নাকি ট্রামে যাত্রী হয় না। ভুল কথা। লক্ষ করেছি, ১) ‘প্রাইম টাইম’-এ ট্রাম খুব কম চালানো হয়। ২) স্টার্টারের টাইম দেখলে বোঝা যাবে, সকাল ন’টা-সাড়ে ন’টা থেকে এগারোটা-সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত এবং বিকেলে সাড়ে আটটা পর্যন্ত ট্রাম সংখ্যায় খুব কম চলে। বিশেষ করে রাসবিহারী মোড় থেকে গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ অবধি প্রচুর যাত্রী থাকেন, কিন্তু ট্রামের অভাবে অটোতে চড়তে বাধ্য হন। ৩) ট্রাম-স্টপ বলে যাত্রাপথে কোনও বোর্ড দেওয়া নেই। ৪) ট্রামলাইন রাস্তার মাঝখানে, তাই যাত্রীদের ওঠানামা করতে খুবই অসুবিধা হয়। ৫) খুব কম যাত্রী নিয়ে ট্রামগুলি চলাচল করে বলে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হয় এবং তাই আওয়াজটাও বেশি হয়।
সুব্রত কুমার দাশ
কলকাতা-২৬
ইতিহাস
ট্রামের ইতিহাস (২৮-৪) শীর্ষক চিঠির সূত্রে জানাই, রাজকর্মচারী ব্রাউনবেরি সাহেব পালকি করে রাইটার্স বিল্ডিং যাতায়াত করতেন। ১৮৭২ সালে তাঁর পালকি-বাহকেরা আধ পয়সা বেতনবৃদ্ধির জন্য ধর্মঘট করেন। তখন সাহেব পালকিতে চাকা লাগিয়ে ছোট ঘোড়াকে দিয়ে পালকি টানানো শুরু করেন। বছরখানেক পর কলকাতার বুকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলতে শুরু করে। (সূত্র: কলকাতা, পূর্ণেন্দু পত্রী)।
পল্টু ভট্টাচার্য
রামরাজাতলা, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy