সুগত হাজরা তাঁর ‘অরণ্য যখন ভেড়ির দখলে’ (৬-৬) শীর্ষক প্রবন্ধে বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সঙ্গে মাছ চাষের বিরোধ মেটানোর ব্যাপারে বিশদে আলোচনা করেছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনে বার বার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদিতে বিপর্যস্ত সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের বাস্তব রূপায়ণ একান্ত জরুরি। ম্যানগ্রোভই পারে বিশাল জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে। বেশ কিছু বছর আগে সুনামির সময় আন্দামানের দ্বীপসমূহ যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, ম্যানগ্রোভ অরণ্য বাঁচিয়ে দিয়েছিল সুন্দরবনকে। ভিয়েতনামে ভেড়ির মধ্যেও ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়। কিন্তু এ দেশে সচেতনতার অভাবে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়েই চলেছে। চিংড়ি চাষ সুন্দরবনের কোর এলাকা ছাড়িয়ে এখন হাসনাবাদ, হাড়োয়া, বসিরহাট, দেগঙ্গা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বছরে তিন বার চাষযোগ্য ভেনামি চিংড়ি চাষ পলিতট, ম্যানগ্রোভ, কৃষিজমি সব দখল করে নিচ্ছে।
সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের একটা অংশই মাত্র এই ‘নীল ফসল’ চাষ থেকে লাভের দাবিদার। মাঝারি, বড় মৎস্যচাষি, মহাজন, ফড়ে, ব্যবসায়ীরাই লাভের গুড় খেয়ে নিচ্ছেন। প্রান্তিক চাষি, মীন জোগাড় করা মহিলারা অতি সামান্য পয়সা পান। এখানে বাগদা চারা প্রজননের আলাদা ব্যবস্থা নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোমরজলে দাঁড়িয়ে মীন সংগ্রহে এক দিকে যেমন অন্য মাছের ডিম, চারা নষ্টে মাছ সরবরাহ কমে আসছে, তেমনই নোনাজলে মহিলাদের সংক্রমণে স্বাস্থ্যের নিদারুণ ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরবনে পাকা বাঁধ দিতে এই সব বৈধ ও অবৈধ চিংড়ি ভেড়িগুলি অন্তরায় হচ্ছে। তা হলে কিছু সংখ্যক মানুষের লোভের আগ্রাসনের কারণে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ কি বছর বছর আমপান, বুলবুল, ইয়াসের মতো ঝড়ে বিপর্যস্ত হবেন? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে সরকারের উচিত কঠোর পদক্ষেপ করা। চিংড়ি চাষের জন্য যেন অবৈধ ভাবে ম্যানগ্রোভ বা চাষজমি দখল না করা হয়। মীন ধরা বন্ধ করে আলাদা চারা প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় বা অন্য রাজ্য থেকে চারা আনানো যায়। জলকে লবণমুক্ত করে জমিতে ধান অথবা অন্য ফসলের চাষ বাড়ানো দরকার। এর ফলে বৃহৎ সংখ্যক সুন্দরবনবাসী উপকৃত হবেন।
সুন্দরবনের মানুষের দাবি, ঝড়ে বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে বছর বছর ত্রাণ তাঁরা চান না, পাকা কংক্রিট বাঁধ তাঁদের চাই। ২০২০ সালের মার্চ মাসে তিন দিক নদী ও এক দিকে সমুদ্র-বেষ্টিত সুন্দরবনের জি প্লট গোবর্ধনপুরে গিয়ে দেখি, জোরকদমে কংক্রিটের বাঁধ দেওয়া চলছে, সঙ্গে ঝাউগাছ ও ম্যানগ্রোভ রোপণও চলছে। সে বছরই ডিসেম্বরে ছিলাম নদীর ধারে, কোনও রকম বাঁধ ছাড়া পাখিরালয় দ্বীপে। ২০২১ সালের ইয়াস ঝড়ের পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, পাখিরালয় ভেসে গিয়েছে, মানুষজন দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে আছেন। কিন্তু জি প্লট গোবর্ধনপুরের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি।