রবীন্দ্রনাথ শুধু নাট্যকার নন, নট ও নির্দেশকও। —ফাইল চিত্র।
অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের ‘রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথ’ (রবিবাসরীয়, ৭-৫) প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। রবীন্দ্রনাথ শুধু নাট্যকার নন, নট ও নির্দেশকও। মনে করা হয় বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে তিনিই নতুন ধারার থিয়েটারের পথিকৃৎ। কয়েকটি ছাড়া তাঁর লেখা সব নাটকই তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। নিরন্তর নিষ্ঠা ও অনুধ্যানে গড়ে উঠত তাঁর প্রতিটি প্রযোজনা পর্ব। এ ব্যাপারে তিনি যেমন জোর দিতেন, তেমনই আবার খুঁতখুুঁতেও ছিলেন।
সাধারণ দর্শকের সমক্ষে রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকি প্রতিভা-তে প্রথম আবির্ভূত হলেও তার আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রহসনে অলীকবাবুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এ বিষয়ে জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তিনি বলেছেন, “বাল্যকাল হইতেই আমার মনের মধ্যে নাট্যাভিনয়ের সখ ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ-কার্যে আমার স্বাভাবিক নিপুণতা আছে। আমার এই বিশ্বাস অমূলক ছিল না, তাহা প্রমাণ হইয়াছে।” এর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মানময়ী গীতিনাট্যে মদনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনয় বিষয়ে খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র-কথা থেকে জানা যায় যে, ঠাকুরবাড়ির একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বিবাহ-উৎসব নামে একটি গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ নারীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। আর এক বারখ্যাতনামা অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির সঙ্গেও তাঁকে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল।
যৌবনে রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ে ভাবাবেগের প্রাবল্য দেখা যেত। তাঁর নিজের মত ছিল যে, “অভিনয়ে কিছু তেজস্বিতা বরং ওভারএকটিং ভাল, যাহাতে অভিনেতার আত্মাভিমানজনিত সঙ্কোচের যে অভ্যাস দ্বারা দূরীকৃত হইয়াছে, তাহার পরিচয় পাওয়া ও দর্শকের প্রাণ স্পর্শ করিতে পারে।” (রবীন্দ্র-কথা, খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)। ১৯০০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সঙ্গীত সমাজের উদ্যোগে অভিনীত বিসর্জন-এর রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় দেখে যতীন্দ্রমোহন বাগচী লেখেন, “সে আমার জীবনের এক অপূর্ব উন্মাদনী অভিজ্ঞতা। কবিবরের রঘুপতির অভিনয় দেখিয়া আনন্দে ও বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হইয়া গেলাম।” ১৯১১-তে রাজা-র অভিনয় দেখে সীতা দেবী লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠাকুরদা সাজিয়া ছিলেন।... ঠাকুরদারূপী কবিবরের নৃত্য দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলাম।” অর্ধেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “অভিনয় হয়েছিল অনবদ্য, এবং গানগুলি আমাকে অভিভূত করেছিল।” ১৯৩৫-এ ৭৪ বছর বয়সে কলকাতায় রাজা-র পরিবর্তিত রূপ অরূপরতন-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদার ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। যাতে তাঁর পরিহাসপ্রিয়তা ও সঙ্গীতরসিক রূপটিকে দেখা যায়। তবে তাঁর শেষ বয়সের অভিনয়ে ছিল সংযমশাসিত শান্তি ও জ্ঞানের অবিচল স্থিতি। সাধারণ নাট্যশালায় গিরিশচন্দ্র-অর্ধেন্দুশেখরের যুগেও কলকাতার শিক্ষিত সমাজ রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ের প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
নৈতিক পুলিশ
‘সাহিত্যের খুঁত’ (২১-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয় অনেক প্রশ্ন তুলে দেয়। সাহিত্যিকের স্বাধীনতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধির বিস্তর ফারাক থাকলে শাসক এবং মাতব্বর শ্রেণি কিছু হাতিয়ার পেয়ে যায়। সলমন রুশদির মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যুগের ঝোড়ো হাওয়ায় অনেক কিছু ভেসে যায়। আর ক্ষমতাবানদের পছন্দের উপর অনেক সময় সাহিত্যের ভাগ্য নির্ভর করে। আমরা যারা বামপন্থী মতাদর্শের সমর্থক, তারা অনেকেই যৌবনকালে রাত ভ’রে বৃষ্টি, বিবর, প্রজাপতি প্রভৃতি উপন্যাস এবং বারবধূ নাটকের বিরুদ্ধে কত বিষোদ্গার করেছি। বুঝতে পারিনি যে, নারী-পুরুষের অবাধ মিলনের হাওয়া দ্রুত ধেয়ে আসছে সারা বিশ্বে, বাংলা তার বাইরে নয়, এবং সাহিত্য তার অগ্রদূত। নৈতিক পুলিশের দায়িত্ব নেওয়া একটা ভুল পদক্ষেপ। অনেক বছর পরে বাংলাদেশের সরকার তসলিমা নাসরিনের সাহিত্যের উপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও লেখককেও নির্বাসনে যেতে বাধ্য করল। মৌলবাদ এবং রক্ষণশীলতা এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাহিত্যের মানুষ হয়েও সম্ভবত কিছু অসহিষ্ণু তত্ত্ববাগীশের পরামর্শে তসলিমার দ্বিখণ্ডিত উপন্যাসের কিছু অংশ বাদ দিয়ে প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু হাই কোর্টে সেই নির্দেশ পরে বাতিল হয়ে যায়।
সাহিত্য এক মহাসাগর, সেখানে গরল যে থাকবে না, তাও বলা যায় না। এ কথাও ভুল নয় যে, কোনও কোনও সাহিত্যিক ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্য বিকৃত করতে পারেন। কোনও সাহিত্যিক যদি ফরমায়েশ মোতাবেক ইতিহাসের মূল্যবান অধ্যায় নিয়ে ধর্মদ্বেষী কিছু লেখেন, তা হলে গোলমাল বাধিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব হবে না। ভাল সাহিত্য যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কিছু অঘটন ঘটিয়ে থাকে, তা গবেষণা করে দেখা দরকার।
বিশ্ববিশ্রুত স্পেনীয় উপন্যাস লা মানচার দন কিহোতে সম্পূর্ণ ধর্ম-নিরপেক্ষ, যার এক আধুনিক রূপান্তরে দেখা যাচ্ছে এক আমেরিকান গবেষক একটি ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন। উপন্যাসে সরাইখানার পরিচারিকা মারিতোর্নেস-কে কুৎসিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আমেরিকার গবেষক ইয়ং জুইম বলেন যে, এর পিছনে ছিল জাতি-বিদ্বেষ। মারিতোর্নেস আস্তুরিয়াস-এর মেয়ে। সেখানে সর্বপ্রথম মুসলমান বিতাড়ন শুরু হয়েছিল বলে উপন্যাসটির মুসলমান অনুবাদক খ্রিস্টান-বিরোধী মনোভাব থেকে এই নারীকে অমন কুৎসিত-দর্শন করেছেন। খ্রিস্টান মেয়েরা সবাই সুন্দরী। গল্পটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে এবং ওটার স্প্যানিশ অনুবাদ করেন সিদ হামেত বেনোগেলি নামের এক আরবীয়, যাঁকে ঋষি-সুলভ বলে বর্ণনা করেছেন লেখক। অনুবাদের কাহিনিটিও লেখকের কল্পনা হতে পারে। কিন্তু আসল কথা হল যে, গবেষণা না হলে এই রহস্য উদ্ঘাটিত হত কি না, সন্দেহ।
ডন জুয়ান (মূল নাটকের নাম ‘দন হুয়ান তেনোরিও’) স্বেচ্ছাচারী লম্পট। সে নিজের পছন্দের সুন্দরী নারীদের ইচ্ছেমতো তুলে আনে, ভোগ করে, বেচে দেয় কিংবা হত্যা করে। কিন্তু খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী দন্যা ইনেসকে সে তুলে আনলেও শ্রদ্ধার আসনে বসায় এবং মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তারও মৃত্যু পর সমাধি প্রেমিকার পাশেই হয়। স্পেনের এই নাটকটিকে রোম্যান্টিক নাটকের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মের জয়জয়কার দেখানোই উদ্দেশ্য ছিল লেখকের। প্রচ্ছন্ন থাকে সামাজিক ব্যাধি। স্বেচ্ছাচার তো কোনও সমাজবরদাস্ত করে না। কিন্তু এখানে ডন জুয়ান স্বেচ্ছাচারী নায়ক। কারণ, ক্ষমতাবান মানুষ আইন লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যায় হামেশাই। তাই ডন জুয়ান আইনের তোয়াক্কা করে না। রাষ্ট্র এবং সমাজের দুর্বলতাকে ব্যঙ্গ করাও ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। নারীশক্তির অবমাননাও ছিল অন্য এক লক্ষ্য।
লা রেহেন্তা বা রাজপ্রতিনিধির স্ত্রী উপন্যাসে চার্চের সঙ্গে এক মেকি আভিজাত্যের প্রতি নিন্দা প্রকাশ পায়। লেখক লেওপোলদো আলাস (ক্লারিন) অভিজাত নারীর সঙ্গে চার্চের কর্তাকে যৌন-কেলেঙ্কারিতে লিপ্ত করে এক বাস্তব চিত্রের উন্মোচন করেন। কিন্তু চার্চ কলঙ্কিত হলেও গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়নি। স্পেনীয় বিজয়ের পর অনেক দিন লাতিন আমেরিকায় নিষিদ্ধ ছিল স্পেনের সাহিত্য। গ্রন্থ রফতানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গোপনে কিছু গ্রন্থ সেই সব দেশে যেত, কিন্তু সাহিত্যপাঠের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। স্পেনের প্রগতিশীল সাহিত্য লাতিন আমেরিকায় স্বাধীনতা-প্রিয়তায় ইন্ধন জোগাতে পারে বলে মনে করেছিল স্পেনের সরকার।
পরবর্তী কালে অবশ্য লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, চার্চের ভণ্ডামি নিয়ে প্রশ্ন, অবাধ যৌনতার প্রকাশ থাকলেও নিষিদ্ধ হয়নি। কারণ সম্ভবত এই যে, কয়েকটি সৃষ্টি নোবেল পুরস্কার অর্জন করে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞার বিরোধী, আর সেখান থেকেই অধিকাংশ ইংরেজি-সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
তরুণকুমার ঘটক, কলকাতা-৭৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy