কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
‘মন্দিরে অনুষ্ঠান, নজরুলের ছবি খুলতে বলা হল’ (২৪-৫) শীর্ষক খবরটির পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রশ্ন যে, তা হলে কি অদূর ভবিষ্যতে মন্দিরগুলিতে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের প্রবেশাধিকারও বন্ধ করে দেওয়া হবে? যদিও ওই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর নবদ্বীপের রাধারানি মন্দির (যেটি সম্প্রতি হেরিটেজ তকমা লাভ করেছে) কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মানুষ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের তীব্র বিক্ষোভের মুখে পড়ে ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায় যে, এই ধরনের জঘন্য মানসিকতা প্রকাশ করার সাহসই বা মন্দির কর্তৃপক্ষ পেলেন কোথা থেকে? আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে বা নাচ-গানের শিক্ষায়তনগুলিতে প্রতি বছর নিয়ম করে একক ভাবে রবীন্দ্র জয়ন্তী বা নজরুল জয়ন্তী, অথবা যৌথ ভাবে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হতে। হয়তো কারও সাহস হত না সর্বসমক্ষে এই ধরনের মানসিকতা প্রকাশ করার। ওই ঘটনা শুধু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সম্বন্ধে অজ্ঞতারই প্রকাশ নয়, এর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্রও আছে কি না, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ভবিষ্যতে এ-রূপ ঘটনা যাতে না ঘটে, সে দিকে পুলিশ-প্রশাসন এবং রাজ্য সরকারকেও প্রয়োজনমতো কঠোর পদক্ষেপ করতে হবে।
আমাদের, বিশেষ করে বাঙালির হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আর চেতনায় নজরুল অধিষ্ঠিত। এঁরা দু’জনেই তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে জাতপাতের ঊর্ধ্বে মানবধর্মের জয়গান গেয়েছেন। সেই নজরুলের ছবি সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা মানে আমাদের চেতনাকেই পরোক্ষে আঘাত করা। এই জাতীয় ঘটনা মনে করিয়ে দেয় কবিগুরুর সেই সাবধান বাণী— “ধর্ম যখন অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমতও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে, তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমনআর-কিছুই না।”
অমিতকুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
বাঙালির সংস্কৃতি
দিনে দিনে আরও কত কী যে দেখতে হবে, কে জানে। ক’দিন আগে নবদ্বীপের রানির ঘাট সংলগ্ন রাধারানি মন্দিরে শিশুদের একটি রবীন্দ্র-নজরুল অনুষ্ঠান ছিল। উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠান শুরুর আগে মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের ছবি দেওয়া ফ্লেক্স টাঙাতে গেলে মন্দির কর্তৃপক্ষ তাতে আপত্তি করেন। তাঁদের আপত্তির কারণ নজরুল ভিন্ন ধর্মের, তাই রবীন্দ্র-নজরুল অনুষ্ঠানে তাঁর ঠাঁই হবেনা। তাঁর ছবিতে মাল্যদানও করা যাবে না।
ভাবতে অবাক লাগে, সারা দেশে আমাদের বাংলাকে সংস্কৃতির পীঠস্থান বলা হয়। এ কোন সংস্কৃতি? বঙ্গভূমিতে কারা আমদানি করল? তা ছাড়া নবদ্বীপ তো চৈতন্য মহাপ্রভুর স্থান। সংস্কৃতির দিক থেকে নবদ্বীপ চিরকালই এগিয়ে এবং খুবই ঋদ্ধ। মন্দির কর্তৃপক্ষ কি জানেন না, না কি বিস্মৃত হয়েছেন যে, মন্দিরে যখন ৬৪ মোহন্তের ভোগের আয়োজন হয়, সেখানে মহাপ্রভুর সঙ্গে যবন হরিদাসেরও একটি আসন থাকে। আর তারা বোধ হয় নজরুলের লেখা শ্যামাসঙ্গীতগুলি (‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে’, ‘অন্তরে তুমি আছো চিরদিন’, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়...’) কখনও শোনেনি। না শুনে থাকলে সেটা তাদের অজ্ঞতা তথা দৈন্যতা। শুনলে বুঝতেন, নজরুল মনেপ্রাণে কত বড় কালীভক্ত ছিলেন। বলা বাহুল্য, নজরুলের মতো মহামানবরা কখনও ধর্মের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন না। তাঁরা চিরকালই এ সবের ঊর্ধ্বে।
অনুমান হয়, মন্দির কর্তৃপক্ষের উপর বিশেষ রাজনৈতিক দলের চাপ আছে। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নজরুলকেও অচ্ছুত করে রাখতে চায়। এবং সে কারণেই মন্দির কর্তৃপক্ষ এমন একটি চূড়ান্ত নিন্দনীয় কাজ করে ফেলেছেন। এ কাজ নবদ্বীপ তথা সারা বাংলার লজ্জা। নজরুল প্রতিবাদের ভাষা, হৃদয়ের উপলব্ধি, বাঙালির হৃদয়ে তাঁর চিরস্থায়ী আসন আছে। তিনি পূজনীয়, এক অর্থে দেবতাস্বরূপ, প্রণম্য । তাঁকে অসম্মান করা শুধুমাত্র নিন্দনীয় নয়, অপরাধও বটে। বঙ্গ সংস্কৃতিতে এই সব সঙ্কীর্ণতার স্থান নেই। নবদ্বীপের মন্দির কর্তৃপক্ষ কাদের প্ররোচনায় এমন একটা অনভিপ্রেত কাণ্ড ঘটালেন, সেটাই ভাবার বিষয়।
পরিশেষে লিখি, যিনি জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিবাদে সরব থেকেছেন, বঙ্গ সমাজকে নানাবিধ অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে লাগাতার লড়াই চালিয়েছেন, আজ কিছু অজ্ঞ মানুষ তাঁকে নিয়ে ধর্মের নামে বজ্জাতি করছে। এ কী পরিহাস!
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
বিদ্বেষের বিষ
‘মন্দিরে অনুষ্ঠান, নজরুলের ছবি খুলতে বলা হল’ শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। নবদ্বীপবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণভক্ত আদিতে ছিলেন শ্রীহট্টের মানুষ। তাঁদের প্রেরণাদাতা গুরু ছিলেন অদ্বৈত আচার্য। শান্তিপুরবাসী মহাপণ্ডিত, স্বনামধন্য এই অধ্যাপকের ছিল সিংহের মতো দাপট, ব্যক্তিত্ব। সেই সময় নবদ্বীপের মধ্যবিত্ত মানুষ সুলতানি শাসনের কোপে পড়ার আশঙ্কায় সব সময়ে কুঁকড়ে থাকতেন। তাঁদের মনে শক্তি জোগাতে নিয়মিত নবদ্বীপে যাতায়াত করতে হত অদ্বৈতকে। সেখানে একটা টোল খুলে পড়াতেন। জ্ঞানচর্চাতেও তিনি ছিলেন সমান উৎসাহী। ছেলের বয়সি যবন হরিদাসের নিরঙ্কুশ ভক্তির মহিমায় মোহিত হয়ে তাঁকে পুত্রস্নেহে নিজের ভদ্রাসনে আশ্রয় দিয়ে দর্শনশাস্ত্র, ভাগবত শিক্ষা দিতে শুরু করল অদ্বৈত। অদ্বৈতের আশ্রয়ে থেকে যবন হরিদাস ধীরে ধীরে ঠাকুর হরিদাসে রূপান্তরিত হল।
সংবাদে প্রকাশ, রবিবার সন্ধ্যায় নবদ্বীপের রানির ঘাট সংলগ্ন রাধারানি মন্দিরে একটি নাচের স্কুলের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র-নজরুলের ফ্লেক্স টাঙানোর সময় মন্দিরের তরফে বলা হয় যে, নজরুলের ছবি রাখা যাবে না। তিনি ভিন্ন ধর্মের মানুষ, তাঁর ছবিতে মাল্যদান করা যাবে না।
ধর্মীয় বিভাজনের বিদ্বেষবিষ কতখানি ছড়ালে যবন হরিদাসের স্মৃতিধন্য নবদ্বীপে এমন একটি ঘটনা দেশের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ করতে হয়। ধর্মের ঠুলি এঁটে থাকা বর্তমান সমাজে এক সময় জাতপাত ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থাকা প্রাক্-ঔপনিবেশিক আধুনিকতার উদ্বোধন ঘটেছিল চৈতন্যদেবের হাত ধরে। অথচ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কোপে পড়ে নবদ্বীপে ঐতিহ্যের তকমা পাওয়া রাধারানি মন্দিরের নাটমঞ্চে নজরুলের ছবি খুলে ফেলতে বলা একটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা। আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক মতামতের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ধ্বজাধারী বিজেপি ধর্মের নামে যে উগ্র হিন্দুত্বের বাতাবরণ তৈরিতে সচেষ্ট, তা এই ঘটনাই প্রমাণ করে। অথচ, এই অসহিষ্ণুতা কখনও উদার হিন্দুত্বের ‘ওয়ে অব লাইফ’ হতে পারে না। প্রকৃত ধর্মবোধ সহিষ্ণুতায় জারিত।
কাজী নজরুল ইসলাম ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় লিখেছিলেন— “যে-লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির-চূড়া,/ সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুঁড়া!/ প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ,/ চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।/ করুক কলহ-জেগেছে তো তবু-বিজয়-কেতন উড়া!/ ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!”
একবিংশ শতকে এসে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে আদি আধুনিকতার জনক চৈতন্যদেবের পুণ্যভূমিতে বঙ্গের আর এক জাতপাতের ঊর্ধ্বে থাকা কবি নজরুলকেও বিভাজনের ঊর্ধ্বে রাখা গেল না।। কবি সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় একদা বলেছিলেন, “ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল।”
তবুও একবিংশ শতকের দুর্ভাগ্য যে, এখনও সমাজের কিছু মানুষ রবীন্দ্র-নজরুলের মাঝেও বিভেদের প্রাচীর খাড়া করে চলেছেন।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy