Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Letters to the editor

সম্পাদক সমীপেষু: বৈষম্যের কালাপানি

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান অনৈক্য প্রবল হয়ে ওঠে। এই বিপদকে রবীন্দ্রনাথ সেই ১৮৯১ সালেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২১ ০৪:১৮
Share: Save:

দীপেশ চক্রবর্তীর ‘কল্যাণ-ভাবনা, আজও’ (৯-৫) প্রসঙ্গে বলি, সম্প্রতি আমাদের দেশে ধর্মীয় মেরুকরণের যে আবাদ হচ্ছে, তা রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতেন। তাঁর অজস্র লেখায় তার প্রমাণ আছে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে মুসলিম ছাত্রের ভর্তি নিয়ে উঠে-আসা সমস্যা তিনি দূর করেছিলেন। মুসলিম যুবক আকুল সরকার ও হিন্দু কন্যা লতার ভালবাসার বিবাহ নিয়ে ঘনিয়ে-ওঠা সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি মোকাবিলা করেছিলেন দৃঢ় ভাবেই। উদাহরণ অনেক। একটা ঘটনার কথা বিশেষ করে বলা দরকার। ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কবি এলেন শিলাইদহে। দেখলেন প্রজাদের বসার তিন রকম ব্যবস্থা। একটা উচ্চাসন ব্রাহ্মণদের জন্য। তার নীচে ভূমিসংলগ্ন স্থানে জাজিম (কার্পেট) পাতা অন্য সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের জন্য। অন্য দিকে জাজিমহীন খোলা জমি মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য। রবীন্দ্রনাথ আদেশ দিলেন ব্যবস্থা পরিবর্তনের। আমলারা যত বোঝাতে লাগলেন এটা দীর্ঘ দিনের রীতি, অপরিবর্তনীয়, ততই রবীন্দ্রনাথ কঠোর হতে লাগলেন। শেষে ঘোষণা করলেন ব্যবস্থা পরিবর্তন না হলে তিনি অনুষ্ঠান বর্জন করবেন। তাঁর জেদের কাছে সকলকে হার মানতে হল। সব প্রজা বসলেন জাজিমপাতা আসনে। মাঝখানে বসলেন বছর তিরিশের সুদর্শন জমিদার রবীন্দ্রনাথ।

আসলে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা বর্বর প্রথাকে আঘাত করলেন। ভিন্ন আসনে বসানোর এই কুপ্রথা জাতিভেদ প্রথার বিষবৃক্ষের গোড়ায় জল দেয়। প্রতিবেশীদের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর গড়ে তোলে। পরবর্তী কালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান অনৈক্য প্রবল হয়ে ওঠে। এই বিপদকে রবীন্দ্রনাথ সেই ১৮৯১ সালেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন। “বাধা ওই জাজিম তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোট নয়। ওটা অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতামঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।”

তৈয়েব মণ্ডল

হরিপাল, হুগলি

হিন্দুর দৈন্য

‘কল্যাণ-ভাবনা, আজও’ নিবন্ধে দীপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন, “...‘স্বরাজ’ নামক বস্তুটি হুড়মুড় করে ভারতের ঘাড়ে এসে পড়ে দেশটাকে দ্বিখণ্ডিত করে,...” রবীন্দ্রচিন্তায় ‘স্বরাজ’ অর্থ অখণ্ড ভারতের ‘স্বরাজ’, গাঁধীজির ‘স্বরাজ’-ও তা-ই। দেশবিভাগের প্রধান কারণ মহম্মদ আলি জিন্না এবং তার পরে জওহরলাল নেহরু। এর সঙ্গে ‘স্বরাজ’-চিন্তার কোনও সম্পর্ক নেই। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের কথা আছে, কিন্তু সেই অর্থে কোনও ‘চিন্তা’ নেই। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খৃস্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না— এই খানে তাহারা একটা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে। সেই সামঞ্জস্য, ‘অহিন্দু’ হইবে না, তাহা বিশেষভাবে ‘হিন্দু’। তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যতই বিদেশের হউক, তাহার প্রাণ, তাহার আত্মা ভারতবর্ষের।” অর্থাৎ, ‘অহিন্দু’ না হওয়ার অর্থ অভারতবর্ষীয় হবে না। আত্মশক্তি পর্যায়ে রবীন্দ্রচিন্তা নিজস্ব সত্তাকে জাগরূক করতে চায়। আর আমরা ধর্মকে খুঁজলেও, হিন্দু ধর্ম যদি সবার সঙ্গে রবীন্দ্রাকাঙ্ক্ষিত সামঞ্জস্য খুঁজে পায়, তা হলে ক্ষতি কী?

‘ব্রাহ্মণ্য’ চিন্তা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথায় লিখি, “সমাজকে নব নব তপস্যার ফল, নব নব ঐশ্বর্যের বিতরণের ভার যে ব্রাহ্মণের ছিল সেই ব্রাহ্মণ যখন আপন যথার্থ মাহাত্ম্য বিসর্জন দিয়া সমাজের দ্বারদেশে নামিয়া আসিয়া কেবলমাত্র পাহারা দিবার ভার গ্রহণ করিল— তখন হইতে আমরা অন্যকেও কিছু দিতেছি না। আপনার যাহা ছিল তাহাকেও অকর্মণ্য ও বিকৃত করিয়াছি।” অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ্যবাদের অধঃপতন এবং তার ফলে হিন্দু ভারতবাসীর দৈন্য প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মণ্যবাদের নব উন্মেষ কামনা করেননি।

রবীন্দ্রচিন্তায় স্বদেশি সমাজপতি কিন্তু সরকারের প্রধান নয়। এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, বাইরে থেকে আরোপিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা উপযুক্ত সমাজপতি গত ৭৪ বছরে পাইনি। তবে আঞ্চলিক স্তরে সমাজপতি থাকা সম্ভব। যেমন, মহারাষ্ট্রের খরাপ্রবণ অঞ্চলে হিওয়ারে বাজার, রালেগাঁও সিদ্ধি এবং নৈটিয়াল আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম বৃহৎ শিল্পের সাহায্য ছাড়া আত্মশক্তিতে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। সেখানে আমরা অন্না হজারে, পোপট রাও পাওয়ারের মতো সমাজপতি দেখেছি। ক্ষুদ্র স্তরের সমাজপতি সৃষ্টির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেলে সমাজে আত্মশক্তির স্ফুরণ সম্ভব। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে হয়তো আমরা আঙ্গেলা ম্যার্কেল বা জেসিন্ডা আর্ডের্ন-এর মতো সর্বদেশীয় সমাজপতি পাব। তখন ‘সমাজপতির প্রয়োজন নেই’ বলে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস না রেখে আপস করতে
হবে না।

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা

অনৈক্যের স্রোত

দীপেশ চক্রবর্তীর নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অখণ্ড দেশে বসে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্র বিষয়ক যে চিন্তা করেছিলেন, তার সবই যে বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিক, তা নয়। তবে কবির কল্পনায় রাষ্ট্রের কল্যাণকামী রূপ, জাতীয় ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষতা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। সেই সময়ের প্রেক্ষিতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যাকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এই বলে যে, “আমাদের রাষ্ট্রীয় ঐক্য সাধনার মূলে একটা মস্ত জাতীয় অবাস্তবতা আছে সে কথা আমরা ভিতরে ভিতরে সবাই জানি, সেই জন্যে সেই দিকটাকে আমরা অগোচরে রেখে তার উপরে স্বাজাত্যের যে জয়স্তম্ভ গড়ে তুলতে চাই তার মালমশলাটাকেই খুব প্রচুর করে গোচর করতে ইচ্ছা করি। কাঁচা ভিতকে মালমশলার বাহুল্য দিয়ে উপস্থিত মতো চাপা দিলেই সে তো পাকা হয়ে ওঠে না, বরঞ্চ একদিন সেই বাহুল্যেরই গুরুভারে ভিতরে দুর্বলতা ভীষণ রূপে সপ্রমাণ হয়ে পড়ে। খেলাফতের ঠেকো দেওয়া সন্ধি বন্ধনের পর আজকের দিনে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।” সাম্প্রতিক বঙ্গের নির্বাচনে মানুষ সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করেছে। কিন্তু সমগ্র ভারত জুড়ে অনৈক্যের যে চোরাস্রোত খেলে বেড়াচ্ছে, তার প্রতিরোধে কালোত্তীর্ণ রবীন্দ্রভাবনাগুলি দ্বারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সচেতন নাগরিকেরই কর্তব্য।

সঞ্জয় রায়

দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

অপ্রিয় সত্য

আনন্দবাজার পত্রিকা-র শতবর্ষ উপলক্ষে আর্কাইভ থেকে যে টুকরো সংবাদগুলি পরিবেশিত হচ্ছে, তার মধ্যে ৩ মে, ১৯২২-এর একটি সংবাদ দৃষ্টি আকর্ষণ করল। শিরোনাম, ‘স্কুল মাষ্টারের মুরুব্বিয়ানা’ (১১-৫)। সংবাদটি হল, “রাজসাহী হইতে জনৈক সংবাদদাতা আমাদিগকে জানাইতেছে যে রাজসাহী কলেজিয়েট স্কুলের একজন শিক্ষক নাকি ক্লাসে বসিয়া মহাত্মা ও অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা অসংলগ্ন বক্তৃতা করেন। এ জন্য অতিরিক্ত কিছু মিলে কি?” সংবাদ ভাষ্যে শিক্ষকের প্রতি যথেষ্ট অসম্মান নিহিত। গত বছর ফ্রান্সে চিন্তার স্বাধীনতা ও তার প্রকাশযোগ্যতার পক্ষে শ্রেণিকক্ষে উদাহরণ-সহ আলোচনার জন্য এক শিক্ষককে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ‘মহাত্মা’-র চিন্তাধারা ও কাজ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। অসহযোগ আন্দোলন নিয়েও সমালোচনা আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই স্বদেশি আন্দোলনের সমালোচনা করেছেন। চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে নিরন্তর সওয়াল করাই এই সংবাদপত্রের ঐতিহ্য। অথচ, সে দিন সমকালীন নেতৃত্ব ও ঘটনাবলির সমালোচনাকে সে ‘অসংলগ্ন’ আখ্যা দিয়েছিল। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সেই শিক্ষককে কুর্নিশ জানাই, যিনি ছাত্রদের কাছে সমকালীন বিষয়ে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছিলেন।

কৌশিক চিনা

মুন্সিরহাট, হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE