Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩
Dilip Kumar

সম্পাদক সমীপেষু: ভাষাময় দুই চোখ

শোনা যায়, দেবদাস-এর এক জরুরি সিকোয়েন্স শুট করার আগের রাত তিনি স্টুডিয়োতে কাটিয়েছেন, অভুক্ত, বিনিদ্র, যথোচিত ‘লুক’ ও ভাব আনার তাগিদে।

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২১ ০৫:০১
Share: Save:

পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় সিনেমার তারকাখচিত পটে যে ত্রিমূর্তি বিরাজ করতেন— রাজ কপূর, দেব আনন্দ ও দিলীপ কুমার— তার শেষতম মানুষটিও চলে গেলেন। দিলীপ কুমার মাত্র ৬০টির মতো ছবি করেছেন দীর্ঘ কেরিয়ারে। এ ক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল। দিলীপ কুমারের এই চয়ন ও বর্জন— এই অতৃপ্তি তাঁকে এমন এক গুণগত উচ্চতায় তুলে দেয়, যার নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য।

Advertisement

এক সময়ে তাঁকে বলা হত ‘ট্র্যাজেডি কিং’। আন্দাজ করা যায়, তরানা বা হালচাল ছবি থেকে তাঁর এই অভিধার সূচনা, যার পরিণতি বিমল রায়ের দেবদাস ছবিতে। শোনা যায়, দেবদাস-এর এক জরুরি সিকোয়েন্স শুট করার আগের রাত তিনি স্টুডিয়োতে কাটিয়েছেন, অভুক্ত, বিনিদ্র, যথোচিত ‘লুক’ ও ভাব আনার তাগিদে।

কিছু সমস্যা হয়েছিল, তাই মনোবিদের পরামর্শে তিনি ওই ধরনের ছবি করা বন্ধ করেন, অতঃপর গঙ্গা যমুনা থেকে শুরু হয় এক আশ্চর্য যাত্রা। কোহিনুর, রাম অউর শ্যাম, আদমি, দিল দিয়া দর্দ লিয়া (‘ওয়াদারিং হাইটস’ উপন্যাসের ছায়ায়) এবং, সেই বহুচর্চিত মোগল-এ-আজ়ম। তখন তিনি অভিনয়ের ‘পাওয়ারহাউস’। স্বরক্ষেপ যখন স্বগতোক্তির মতো নিচু পর্দায়, তখনও প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। যখন তীব্র উচ্চগ্রামে, তখনও তা শম্ভু মিত্রের ভাষায়— ‘অনাবশ্যক কণ্ঠবাদন’ নয়। গভীর, ভাষাময় চোখ, অভিব্যক্তিতে সহস্র ভাবের ব্যঞ্জনা। দিলীপ কুমারের ক্লোজ়-আপের পর্যালোচনা ভিন্ন অভিনয়ের পাঠক্রম অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমার এক বন্ধু উত্তমকুমার ছাড়া কিছু বোঝে না। সেও সাগিনা মাহাতো দেখে বলেছিল, “কষ্ট হচ্ছে বলতে, কিন্তু মনে হল এটা বোধ হয় গুরুও পারত না!”

সুরঞ্জন চৌধুরী

Advertisement

কলকাতা-৯৭

মুক্তচিন্তা

কৌশিক সেনের প্রবন্ধ (‘কিন্তু, আমরা কোন দিকে?’, ২৬-৬) প্রসঙ্গে সংযুক্তা দত্তের যে চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে, (‘স্তালিনের স্তাবক?’, ৪-৭) তা প্রবন্ধের মূল বিষয় থেকে সরে গিয়েছে। হিটলারের জার্মানিতে সে দেশের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিকর্মীদের ভাগ্যে যা ঘটেছিল, স্তালিনের সময়কার রাশিয়াতেও হয়েছিল প্রায় সে রকমই, সে কথার অসংখ্য প্রমাণ আজ সারা বিশ্বের সামনে আছে। সেখানে সেই সময়ে যে লেখক-শিল্পী, অভিনেতা বা চিন্তাশীল মানুষরা দাঁতে দাঁত দিয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যান, তাঁদের কাউকে ‘মেরুদণ্ডহীন মানুষ’ বলা এই প্রবন্ধে চোখে পড়েনি। অবশ্য তাঁরা ‘স্তালিন-পরিচালিত সমাজতন্ত্রের মধ্যে মানবাত্মার মুক্তির’ ঠিক কোন পথ দেখতে পেয়েছিলেন, তার উল্লেখও চিঠিতে পেলাম না।

কিন্তু স্তালিন বা হিটলার প্রবন্ধটির বিষয় ছিল না। এই লেখাটি আজ সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ অন্য জায়গা থেকে। স্বাধীন চেতনা একটি সংস্কৃতি। ফ্যাসিবাদ, অর্থাৎ ‘একমাত্র তন্ত্র’-এর ভাবনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য তাকে বহু যত্নে নির্মাণ, প্রচার ও লালন করতে হয়। বিকল্প চিন্তা বা মতানৈক্য পোষণ করার এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যা এককেন্দ্রিকতার আমূল বিরোধিতা দিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যের অধিকার রক্ষা করে, রাজনৈতিক পার্টিগুলির মেরুকরণের মধ্যে তাকে টিকিয়ে রাখা সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কৌশিকের বক্তব্যের মূল জায়গাটি আরও সূক্ষ্ম একটি চাপের দিকে নির্দেশ করছে— কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়, আজ প্রায় সব দলই মতানৈক্যের অধিকারের বিরোধী। হয় তুমি আমার অকুণ্ঠ সমর্থক, না হলে শত্রু— এই বিকল্প চিন্তাহীন নিরঙ্কুশ মানসিক অধীনতাই ক্ষমতায় থাকা, বা থাকতে-চাওয়া দলগুলির কাম্য। প্রায় তিন-চার দশক ধরে আমরা ক্রমশ এখানে এসে পৌঁছেছি। এই সাদাকালো বিভাজনের বাইরে, নিজস্ব বিচারবুদ্ধি বা স্বাধীন ভাবনার প্রকাশ যে সংস্কৃতিকর্মীদের আরাধ্য, তাঁরা ক্রমশ পা রাখার জায়গা হারাচ্ছেন। যে কোনও গণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে এটা বিপজ্জনক। কৌশিক সেনের লেখাটি আমাদের অনেকের কাছে সেই পা রাখার জায়গা পুনরুদ্ধারের বার্তা হয়ে দেখা দিয়েছে।

জয়া মিত্র

আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান

মুক্তিযুদ্ধের গান

‘মুক্তিযুদ্ধের গানওয়ালারা’ (রবিবাসরীয়, ৪-৭) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর সঙ্গেও পরোক্ষে যুক্ত ছিলেন এ-পার বাংলার সঙ্গীত শিল্পীরা। অপারেশন শুরুর সঙ্কেত নির্ধারিত হয়েছিল দু’টি গানে, যা সম্প্রচার করা হয়েছিল আকাশবাণী কলকাতা খ-এর বিশেষ অনুষ্ঠানে। প্রথমটি ছিল পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’। যার অর্থ হল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন শুরু করতে হবে। এটি সম্প্রচারিত হয় ১৩ অগস্ট (১৯৭১)। দ্বিতীয় সঙ্কেত ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’, যা সম্প্রচারিত হয় ১৪ অগস্ট। এর অর্থ, আক্রমণের সময় এসে গিয়েছে, এ বার ঘাঁটি ছেড়ে বেরোতে হবে। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, ১৫ অগস্ট বাংলাদেশের নৌসেনার পক্ষ থেকে পরিচালিত হয় সেই দুঃসাহসী অভিযান, যা মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৯৭১ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় ‘বাংলা! আমার বাংলা!’ নামের একটি ইপি রেকর্ড, যার এক দিকে ছিল ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে’ এবং ‘মানবো না এ বন্ধনে’, আর উল্টো দিকে ছিল ‘ও আলোর পথযাত্রী’ ও ‘আহ্বান শোন আহ্বান’। ‘ধন্য আমি’ আর ‘ও আলোর পথযাত্রী’ অনেক আগেই লেখা হয়েছিল গণনাট্য আন্দোলনের গান হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এগুলি নতুন করে জনপ্রিয় হয়। সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে এই গানগুলিতে মান্না দে-র সঙ্গে ছিলেন সবিতা চৌধুরী ও অন্যান্য সহশিল্পী। একই ভাবে, ভারত-চিন যুদ্ধের সময় আকাশবাণীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, নিজের সুরে ‘মাগো ভাবনা কেন’ আর ‘এ দেশের মাটির পরে’। ১৯৭১-এ গান দু’টি নতুন করে রেকর্ড করেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামে এলপি রেকর্ড। এতে ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীর গাওয়া ১২টি গান। রচয়িতা ছিলেন দুই বাংলার খ্যাতনামা গীতিকাররা।

মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে দুর্বারগতি পদ্মা নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্ণ হল, অমূল্য তথ্যচিত্রটিরও তা-ই। এক মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে ফুটে ওঠে দেশভাগ, আর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্কটপূর্ণ কাহিনি। চিত্তপ্রসাদের হাতে আঁকা সাদা-কালো ছবি, খবরের কাগজের কাটিং-এর কোলাজ, আবহে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ বা নির্মলেন্দু চৌধুরীর গলায় ভাটিয়ালির সুর। প্রযোজনা করেছেন বিশ্বজিৎ, কথক-সৈনিকের অভিনয়ও করেছেন। দেখা যায়, শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘টাকডুম টাকডুম বাজাই’ গাইছেন শচীন দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরীর পরিচালনায় ‘শুনো শুনো ভাই সব হিন্দু মুসলমান’ গাইছেন মান্না দে। ত্রাণ সংগ্রহে দেখা যাচ্ছে শ্যামল মিত্রকে। শেষে মুক্তিযোদ্ধা-কথক প্রশ্ন রাখছেন, “আমরা কি এখানেই থামব মশাই?” এ প্রশ্ন আজও ভাবায়।

পৃথা কুন্ডুু

কলকাতা-৩৫

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.