Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
Dahan

সম্পাদক সমীপেষু: সেই সব সাহসিনী

বিশেষত এক জন মেয়েকে নানা ভয় কাটিয়ে উঠতে হয়— সামাজিক বন্ধন উপেক্ষা করা, প্রতিবাদ করা, সংসার ভেঙে যাওয়া, একা থাকা, এ সব কিছুর ভয়ই কাটিয়ে উঠতে হয়।

An Image Of Rituporno Ghosh

(বাঁ দিক থেকে) ইন্দ্রাণী হালদার, সুচিত্রা মিত্র এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:১৭
Share: Save:

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্তের ‘ছকভাঙা মেয়ের দাপট’ (২-১২) প্রবন্ধটি পড়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন (১৯৯৭) চলচ্চিত্রটি আবার দেখলাম। সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর কালজয়ী উপন্যাসে সে কালের কলকাতার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন ও মনোভাব নিবিড় ভাবে তুলে ধরেছেন। একটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে এই উপন্যাসে এক সাহসী নারী (ঝিনুক) চরিত্রকে যে ভাবে আঁকা হয়েছে, পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ চলচ্চিত্রে তাকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। ঝিনুকের ঠাম্মার (অভিনয়ে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র) চরিত্রায়ণ যে ভাবে করা হয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে যে, ঠাম্মা নিজের মতো করে বাঁচেন, এবং তাঁর নাতনি ঝিনুককে শিক্ষা ও সাহস জোগান, সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। এখানেই এই চরিত্রটির সার্থকতা— এটি এমন এক মেয়ের যিনি স্রোতের বিপরীতে ভাসতে জানেন, ন্যায় ও সত্যের বিচার করতে জানেন। মানুষ তাঁদের সব সময় একটু অন্য চোখে দেখে, এবং সাধারণত মেনে নিতে পারে না। স্রোতের বিপরীতের এই মানুষগুলোই সমাজে নতুন জোয়ার এনে দিতে পারে।

নিজের মতো করে বাঁচার জন্য সাহসে ভর করতে হয়। বিশেষত এক জন মেয়েকে নানা ভয় কাটিয়ে উঠতে হয়— সামাজিক বন্ধন উপেক্ষা করা, প্রতিবাদ করা, সংসার ভেঙে যাওয়া, একা থাকা, এ সব কিছুর ভয়ই কাটিয়ে উঠতে হয়। সুচিত্রা মিত্র বাস্তবে তাঁর নিজের জীবনেও এমন অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রার প্রধান অবদান তাঁর গান, তবে তাঁর জীবন দিয়েও তিনি সমাজ-সংসারে নতুন দিশা দেখিয়েছেন। জন্মশতবর্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর জীবন চর্যার স্মরণ-মননের মধ্য দিয়ে এক নারীর বহুমুখী কর্মকাণ্ড প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁর চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি ছিল রাজনীতি-সচেতনতা, যার জন্য তিনি গণনাট্য আন্দোলনের শরিক হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সংগ্রামী জীবন তাঁর। যেমন ঘরে, তেমনই বাইরে। অশান্তি যত আঘাত করেছে তাঁকে, ততই গানের বীণা বেজে উঠেছে তাঁর কণ্ঠে। সাহস যেমন তাঁর ছিল, সততাও ছিল। ছক-ভাঙা হয়ে জীবনকে অন্য রকম ভাবে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।

সন্তোষ কুমার দে, হাওড়া

পিছিয়ে বাংলা

‘বাল্যবিবাহ: সমন্বয়েই প্রতিরোধ’ (১১-১২) শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক দেখিয়েছেন, তথ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে বাল্যবিবাহের গড় হার ২৩.৩ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের সেখানে তা ৪১.৬ শতাংশ। অর্থাৎ, আমরা পিছিয়ে আছি কন্যাসন্তানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে। বাল্যবিবাহের পিছনে একাধিক কারণ আছে। অধিকাংশ পরিবারে কন্যাসন্তানকে পুত্রসন্তানের সঙ্গে সমদৃষ্টিতে দেখা হয় না। মেয়ে একটু বড় হলে অন্যের ঘরে চলে যাবে, তাই পরিবার থেকে মেয়েদের খুব বেশি সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এই মনোভাব কাজ করে। এখনও পর্যন্ত কন্যাসন্তানের বিবাহের পর, পিতা তার বিষয়সম্পত্তি পুত্রের নামে লিখে দেন। কন্যাকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়া যাবে না।

সামাজিক নিরাপত্তার অজুহাতে নাবালিকার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কন্যাসন্তানের উপযুক্ত পরিবেশে তৈরি করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। শিশু ও নারী পাচার চলছে বহাল তবিয়তে। সরেজমিনে খোঁজখবর নিয়ে দেখলে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পরিসংখ্যান উঠে আসবে। এখন সমাজমাধ্যমে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, মন্তব্য, ভিডিয়ো ঘোরাঘুরি করছে, যেগুলি অল্পবয়সিদের নানা ভাবে প্রভাবিত করে। তা ছাড়া, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

বর্তমানে প্রতিটি গ্রামে জনপ্রতিনিধি, আশাকর্মী, সিভিক ভলান্টিয়ার, স্কুলশিক্ষক আছেন। তা সত্ত্বেও কী করে এতগুলো চোখ এড়িয়ে নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে? গ্রামাঞ্চলে কন্যার বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়ার পরেও কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে বহু পরিবার। আমি নিজে আমাদের গ্রামে দেখেছি, বছরের পর বছর বাল্যবিবাহ চলছে। অনেক অভিভাবককে ব্যক্তিগত ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে খুব বেশি লাভ হয়নি। এনজিও-দের তরফে পথনাটক-সহ বিভিন্ন ভাবে প্রচার করা হয়েছে। তবুও কাজের কাজ হয়নি। তবে পুলিশি অভিযানে ধরা পড়লেই হাজতবাস অবধারিত, এ কথা বুঝতে পেরেছে অধিকাংশ মানুষ। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে পুলিশি অভিযান চালানো দরকার। সেই সঙ্গে সরকারি সব ধরনের সুযোগসুবিধা থেকে বিরত করতে হবে অভিযুক্ত অবিভাবককে।

সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

বোমার ভয়ে

নিখিল সুরের ‘আশি বছর আগেই ধ্বংস হয়ে যেত কলকাতা’ (রবিবাসরীয়, ৩-১২) প্রবন্ধটি প্রকৃত অর্থেই মূল্যবান একটি ঐতিহাসিক দলিল। আমার বয়স উল্লিখিত বছরের তিন বছর পরে। আমার ছোটবেলায় এবং পরবর্তী সময়ে বড়দের মুখে শুনে আসা গল্প কাহিনির অনেকটা জুড়েই থাকত যুদ্ধকালীন কলকাতা শহর, ও দেশের পরিস্থিতির কথা, যেগুলো এখনও স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে। সে সময়ে বোমাতঙ্কে আমাদের পরিবারকেও শহর হাওড়ার বাসস্থান ছেড়ে তখনকার মার্টিন কোম্পানির ছোট রেলগাড়ি চড়ে চলে যেতে হয়েছিল শহর থেকে ত্রিশ মাইল দূরের গ্রামে, দেশের বাড়িতে। যাঁদের কোনও উপায় ছিল না, বোমার আতঙ্ক নিয়েই তাঁদের থাকতে হয়েছে শহরে। আমার বাবা যুদ্ধের প্রয়োজনে তৈরি হওয়া ‘এয়ার রেড প্রিকশন’ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে শহরের বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি। বড় হয়ে বাবার মুখ থেকে সেই সময়কার পরিস্থিতির কথা শুনেছি।

সেই সময়ে শোনা যুদ্ধের কথা ও পরিস্থিতির মতোই অস্বাভাবিক এক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছে। সময়টা ষাটের দশকের শুরু। তখন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে চিন আমাদের ভারত ভূখণ্ডের উপর আক্রমণ হেনেছিল। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কেমন হয়, তা আমাদের দেখতে হয়েছে। রাতের বেলায় গোটা শহর, শহরতলি এবং সংলগ্ন অঞ্চল নিষ্প্রদীপ রাখা হত। সন্ধ্যার পর রাস্তায় কোনও আলো জ্বলত না। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। আমাদের কারও বাড়ির আলো যাতে রাস্তার উপর গিয়ে না পড়ে, সে জন্য জানলা-দরজা বন্ধ করার পরও কাপড় দিয়ে তা ঢেকে রাখতে হত। জানলার কাচের শার্সিতে কাগজ সেঁটে দেওয়া হত, যাতে আলোর রেশ বাইরে না যায়। তা ছাড়া বোমা বর্ষিত হলে তার শব্দের আঘাতে কাচ ভেঙে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে যাতে কোনও বিপদ ঘটাতে না পারে, সে জন্যেও এই ব্যবস্থা করা হত। রাতে পথে বার হওয়া গাড়ির ‘হেডলাইট’-এর উপরের প্রায় তিন ভাগ কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হত, বা কালো রঙের মোটা প্রলেপ দেওয়া হত। রাতে মানুষের চলাফেরার উপরেও যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকত। রাজপথে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর টহল চলত। মাঝে মাঝেই বাড়ির দরজায় লাঠির ঠোকা পড়ত। স্থানীয় পুলিশকর্মীরা এসে, “রাস্তার উপর ঘরের আলো গিয়ে পড়েছে” বলে অভিযোগ জানাতেন। আলো বন্ধের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়ে যেতেন। মানুষজনকে আগাম সতর্ক করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিপদসঙ্কেতের শব্দ ‘সাইরেন’ বাজানো হত।

সেই সময়ে কলেজের পড়ুয়াদের বাধ্যতামূলক ভাবে সেনা-প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। আমাদের কলেজে সাম্মানিক স্নাতকস্তরে পাঠগ্রহণের সময় পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে তিন ঘণ্টা সময়কাল ধরে ‘এনসিসি’-র মাধ্যমে সামরিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়েছে। তখনকার দিনের লবণ হ্রদের খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। পত্রিকায় প্রকাশিত মূল্যবান রচনাটি পড়ে সে দিনের সেই ছবিগুলোর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। আর তাই এই স্মৃতিকথন।

অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE