Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: বন্ধু হলেন বিরোধী

বিদ্যাসাগর ১৮৬৬-তে যখন সরকারের কাছে বহুবিবাহ বিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে দ্বিতীয় আবেদনপত্র পেশ করেছেন, সেই সময় কলকাতার ‘সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা’ও এই কুপ্রথা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রচার চালাচ্ছিল ও বহুবিবাহ রদে আইনপ্রণয়নের জন্য একটি আবেদনপত্রে সই সংগ্রহ করছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ বিদ্যাসাগর’ (পত্রিকা, ১২-১০) নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘‘পরিচিতদের থেকে পাওয়া আঘাত, অপমানই বড় হয়ে বেজেছে তাঁর বুকে।’’ সে প্রসঙ্গে বলি, ১৮৫৫-য় বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত বই প্রকাশের কিছু দিন আগে কলকাতার পটলডাঙার শ্যামাচরণ দাস নিজের বিধবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় এক ব্যবস্থাপত্রে বিধবাবিবাহের সমর্থক পণ্ডিতদের সই সংগ্রহ করেন। বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন তাঁর ‘বিদ্যাসাগর জীবনচরিত’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘উহাতে কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ন, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত, ঠাকুরদাস চূড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রভৃতি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের স্বাক্ষর ছিল।... কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, কিছু দিন পরে তাঁহারাই আবার বিধবাবিবাহের বিষয় বিদ্বেষী হইয়া উঠেন।’’

বিদ্যাসাগর ১৮৬৬-তে যখন সরকারের কাছে বহুবিবাহ বিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে দ্বিতীয় আবেদনপত্র পেশ করেছেন, সেই সময় কলকাতার ‘সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা’ও এই কুপ্রথা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রচার চালাচ্ছিল ও বহুবিবাহ রদে আইনপ্রণয়নের জন্য একটি আবেদনপত্রে সই সংগ্রহ করছিল। বিদ্যাসাগর কার্যত এতেই উৎসাহিত হয়ে ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন (১৮৭১) এবং সেই পুস্তিকায় ‘সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা’র উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। এই সভার পরিচালক ও সদস্যবৃন্দের মধ্যে তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। পুস্তিকাটির উপসংহারে বিদ্যাসাগর এও লিখলেন যে তিনি শুনেছেন তর্কবাচস্পতি নাকি মত পরিবর্তন করে বহুবিবাহকে শাস্ত্রসম্মত বলে প্রচার করছেন, তাঁর মতে যা একেবারেই অবিশ্বাস্য ঘটনা।

‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ এই সময় (১৮৭১) লিখছে, ‘‘দুঃখের বিষয়ও বলিতে হইবে যে তাঁহার (বিদ্যাসাগরের) পূর্ব্ব সহচর কয়েকটি পণ্ডিত তাঁহার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছেন’’ (১২৭৮-এর আশ্বিন সংখ্যা)। ১২৭৮ বঙ্গাব্দে (অগস্ট ১৮৭১) ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের উৎসাহেই তারানাথ লিখলেন, ‘‘তিনি (বিদ্যাসাগর) বহুবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনার্থে যেরূপ শাস্ত্রের অভিনব অর্থ ও যুক্তির উদ্ভাবন করিয়াছেন,... বিবেচনা করিয়া দেখিলে ঐ অর্থ ও যুক্তি শাস্ত্রানুমোদিত বা সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। ...শিক্ষার প্রভাবে উহা (বিধবাবিবাহ) এককালে অন্তর্হিত হইবে। অতএব তজ্জন্য আইনের আবশ্যকতা নাই।’’ ভূদেব মুখোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করে লিখলেন, ‘‘তর্কবাচস্পতি মহাশয় কয়েক বৎসর পূর্বে বহু পরিণয় নিবারণার্থে রাজবলের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছিলেন বলিয়া কি তাহা চিরকালই করিতে হইবে?’’

১৮৬৬ সালে বাংলার ছোটলাট সিসিল বিডন বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আইনপ্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সদস্য জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সরকারের কাছে পেশ করা বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ বিরোধী আবেদনপত্র সই করেছিলেন, অথচ কমিটির সদস্য হিসেবে সরকারের কাছে আইনপ্রণয়নের বিরুদ্ধেই মত দিলেন। বিদ্যাসাগরের বন্ধু কৃষ্ণদাস পাল ও রাজেন্দ্রলাল মিত্রও সরকারের কাছে আইনপ্রণয়নের বিরুদ্ধেই মত দিলেন। ‘হিন্দুমেলা’র প্রবর্তক নবগোপাল মিত্র তাঁর ‘ন্যাশনাল পেপার’ পত্রিকায় বিদ্যাসাগরকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন যে সমাজসংস্কার নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে তিনি যেন সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় (১২৮০, আষাঢ়) বঙ্কিমচন্দ্র তীব্র আক্রমণ করে লিখলেন, ‘‘...বিদ্যাসাগর বলিয়াছেন, ‘তোমরা কেহ কিছু জান না, ধর্মশাস্ত্রে যাহা কিছু জানি তা আমিই’’’।

‘সোমপ্রকাশ’-এ প্রকাশিত (৭ জ্যৈষ্ঠ, ১২৭৪) একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে প্রায় ৬০টি বিধবাবিবাহ দিয়ে বিদ্যাসাগরের প্রায় ৩৫০০০ টাকার ঋণ হয়েছিল। এই অবস্থায় সুহৃদ প্যারীচরণ সরকার আর্থিক সাহায্যের আশায় গেলেন কলকাতার অন্যতম ধনী পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের কাছে এবং যথারীতি খালি হাতেই তাঁকে ফিরতে হল। এর পর ১৮৬৭-তেই বিদ্যাসাগরের জন্য একটি ফান্ড তৈরির চেষ্টায় জল ঢাললেন বিদ্যাসাগর নিজেই। তিনি লিখিত ভাবে জনসাধারণকে জানালেন যে তাঁর ব্যক্তিগত ঋণ শোধ করার জন্য ফান্ড তৈরি করার কোনও প্রয়োজন নেই। ফান্ডের টাকা কেবলমাত্র আগামী দিনের বিধবাবিবাহের জন্যই খরচা করতে হবে। বিদ্যাসাগর পরে লিখেছিলেন, ‘‘অধিকাংশ ব্যক্তিই অঙ্গীকৃত সাহায্যদানে পরাঙ্মুখ হইয়াছেন। ...যাহা হউক আমি এই ঋণ পরিশোধের সম্পূর্ণ চেষ্টা দেখিতেছি। অন্য উপায়ে তাহা না করিতে পারি, অবশেষে আপন সর্বস্ব বিক্রয় করিয়াও পরিশোধ করিব’’ (‘বিদ্যাসাগর’— চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)।

সেই সময়ের ‘নব্যভারত’ পত্রিকার সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর লেখা থেকে জানতে পারা যায় যে বিধবাদের চোখের জল মুছিয়ে দিতে গিয়ে আর্থিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত

এ-হেন নীলকণ্ঠ বিদ্যাসাগরকে বিধবাদের আশ্রয় দেওয়ার ‘অপরাধ’-এ শিক্ষিত বাঙালির কাছ থেকে সে দিন ‘চরিত্রহীন’ জাতীয় গালমন্দও শুনতে হয়েছিল।

পীযূষ রায়

কলকাতা-৩৪

আধার ছিল না

‘নীলকণ্ঠ বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক রচনায় লেখক বিদ্যাসাগরের দান বা দানধর্মী অনুগ্রহ স্বীকারে অনীহা প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘‘তা সে ইংরেজ সরকার বা বর্ধমানের মহারাজা— যাঁরই দেওয়া হোক।’’ এবং ‘‘এই আচরণের জন্য ‘অহঙ্কারে একেবারে চক্ষু কর্ণ উভয়েন্দ্রিয় হারাইয়াছেন’ বিদ্যাসাগর এমন তোপ দেগে বসল ‘সম্বাদ ভাস্কর’।’’

বিষয়টা একটু বিশদে বলার অপেক্ষা রাখে। সে বার বর্ধমানের রানি (রাজা নন) কলকাতার জ্ঞানীগুণী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সম্মান জানানোর জন্য বিরাট দানের আয়োজন করেন। একে ‘পণ্ডিত বিদায়’ বলা হত। বিদ্যাসাগর এই ‘বিদায়’ নিতে অস্বীকার করেন। কারণ, জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য পরিশ্রমহীন পারিতোষিক গ্রহণ তাঁর আত্মমর্যাদাবোধের বিরোধী ছিল।

জনৈক ব্যক্তি পত্র লিখে তাঁর এই আচরণের প্রতিবাদ জানান, যা ১৮৫৪ সালের ২২ জুলাই ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এ প্রকাশিত হয়: ‘‘বর্দ্ধমানেশ্বরী শ্রীল শ্রীমতী মহারাজ্ঞী তুলাদান করিয়া কলিকাতাস্থ প্রধান পণ্ডিতগণের নিকট বিদায় প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহা আদরে সকল মহাশয়েরা গ্রহণ করিয়াছেন তন্মধ্যে কেবল শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় উক্ত বিদায় গ্রহণ করেন নাই। কহিয়াছেন যে আমি গভর্মেন্টের স্থানে তিন শত টাকা মাসিক বেতন পাইতেছি তাহাই আমার যথেষ্ট হইয়াছে আর অন্য প্রকারে উপার্জ্জন করিতে বাসনা নাই,... বিদ্যাসাগর গভর্মেন্টের অধিক প্রিয়পাত্র হইলেও বর্দ্ধমানেশ্বরীর

দান অবজ্ঞা করিয়া ফিরিয়া দেওয়া অতি অসঙ্গত কার্য্য হইয়াছে আমি বোধ করি...’’

বিদ্যাসাগরের আচরণ সে-কালের অনেক মানুষ কী ভাবে গ্রহণ করত— এই পত্রে তা প্রকাশ পেয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই তাঁর মহত্ত্বকে অনুধাবন করার ক্ষমতা অনেকের ছিল না। মহাপুরুষের ভাবনা বোঝার জন্য জাতির একটা মানসিক অাধার প্রয়োজন। তা তখন ছিল না, এখনও কি আছে?

উজ্জ্বলকুমার মণ্ডল

শেওড়াফুলি, হুগলি

আরও এক?

‘গণপিটুনির সাজা’ (১২-১১) শীর্ষক খবরে জানলাম, আদালত ১২ জন অপরাধীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তি দিয়েছে, জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড। প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত্যুর পর তাঁরা আরও এক বছর কারাবাস করবেন কী করে?

অশোককুমার দাস

কলকাতা-৭৮

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE