Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: মুক্তির অর্থ

ক্ষুরধার ব্যঙ্গ, তথ্য ও তত্ত্বের সার্থক মিলন এবং বিতর্কের কশাঘাতে জার্মেন গ্রিয়ারের লেখা দ্য ফিমেল ইউনাক গ্রন্থটি চিন্তাজগতে বিপ্লব এনেছিল বললে অত্যুক্তি হয় না।

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:১৪
Representational image of Society.

শৈশব থেকেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একটি বালিকাকে নারী হয়ে ওঠার শিক্ষা দেয়। প্রতীকী ছবি।

মল্লারিকা সিংহ রায়ের ‘স্বাধীন মানেই স্বেচ্ছাচারী?’ (২১-১) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে দু’একটি কথা। সিমোন দ্য বোভোয়া তাঁর আকর গ্রন্থে (দ্য সেকেন্ড সেক্স) লেখেন, শৈশব থেকেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একটি বালিকাকে নারী হয়ে ওঠার শিক্ষা দেয়। সে বুঝতে শেখে নারী নয়, পুরুষই সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর। আর তিন-চার বছরের বালককেও সমাজ বুঝিয়ে দেয় সে এক ‘ক্ষুদ্র পুরুষ’। পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের ধারণার এই সূত্রপাত সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই। পিথাগোরাসের মতে, শৃঙ্খলা, আলোক এবং পুরুষের স্রষ্টা এক মহান নীতি এবং বিশৃঙ্খলা, তমসা ও নারী এক অশুভ শক্তিপ্রসূত। আর ‘নারী নরকের দ্বার’ জাতীয় কথাগুলি তো বহুশ্রুত। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে লেখা হয়, ঋতুমতী নারী স্পর্শ করা মাংস নষ্ট হয়ে যায়। কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার পোশাক সংক্রান্ত বিতর্ক জন্ম নিয়েছে এই মানসিকতা থেকে। নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তরুণদের যে উদ্বেগের কথা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এই মানসিকতারই প্রকাশ, যা নারীকে ‘অপর’ বলে ভাবতে শেখায়।

ক্ষুরধার ব্যঙ্গ, তথ্য ও তত্ত্বের সার্থক মিলন এবং বিতর্কের কশাঘাতে জার্মেন গ্রিয়ারের লেখা দ্য ফিমেল ইউনাক গ্রন্থটি চিন্তাজগতে বিপ্লব এনেছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। ঝরঝরে অথচ বলিষ্ঠ গদ্যের সহায়তায় লেখিকা নারী-সংক্রান্ত গতানুগতিক ধারণাগুলিকে ধূলিসাৎ করেন। নারীর ‘ব্যক্তি’ হয়ে ওঠার স্বাধীনতার (ফ্রিডম টু বি আ পার্সন) সপক্ষে তিনি লেখনীকে করে তুলেছেন এক অমোঘ আয়ুধ। তাঁর কাছে নারী স্বাধীনতার অর্থ ভয়, ক্ষুধা থেকে মুক্তি, বাক্‌স্বাধীনতা আর চিন্তার জগতে মুক্তি। তিনি কমিউনিজ়মের ‘আকস্মিক মৃত্যু’-কে চিহ্নিত করেন দুনিয়া জুড়ে নারীদের দুর্দশায় নিমজ্জিত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে।

প্রায় দেড়শো বছর আগে ইবসেন-এর নাটকের চরিত্র নোরা ঘোষণা করেছিল, নারীর নিজের প্রতিও কর্তব্য আছে এবং তাকে হয়ে উঠতে হবে পরিপূর্ণ মানুষ। নারীমুক্তি আন্দোলন ‘অর্ধেক আকাশ’ জয় করলে আসবে‌ মানবমুক্তি।

শিবাজী ভাদুড়ি, হাওড়া

বাবরনামা

ব্রিটিশ ভারতে প্রকাশিত বাবরনামা-র ইংরেজি অনুবাদে ১৫২৮ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর, এই সাড়ে পাঁচ মাস সময়কালের মোগল বাদশাহ জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের দিনলিপির পৃষ্ঠাগুলি অনূদিত হয়নি বা বাদ দেওয়া হয়েছিল। হিন্দুত্ববাদীরা বলেন যে, ওই সময়েই বাবরের সেনাপ্রধান মির বাকি তাসখান্দি অযোধ্যায় রামজন্মভূমি ধ্বংস করে ১৫২৮ সালে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ওই ইংরেজি অনুবাদ (৫২২ পৃষ্ঠার, তৎসহ ৬১ পৃষ্ঠার ভূমিকা ও সংযোজনী) করেছিলেন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসার হেনরি বেভরিজ-এর স্ত্রী অ্যানেট সুজ়ানা বেভরিজ। বইটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আটানব্বই বছর পরে ২০২০ সালে বইটির পুনর্মুদ্রণ করেছে ‘এভরিম্যান’স লাইব্রেরি’।

মূল বাবরনামা লেখা হয় চাঘতাই তুর্কি ভাষায়। আরবি ভাষায় অনূদিত সংস্করণের নাম ‘বাবরনামে’। দিনলিপি-সহ মূল স্মৃতিকথার নাম ছিল তুজ়ুক-ই-বাবুরি, যার মূল পাণ্ডুলিপি উজ়বেকিস্তানের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এ সুরক্ষিত আছে। বেভরিজ লিখেছেন, তিনি তুর্কি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু এ থেকে স্পষ্ট হয় না, তিনি চাঘতাই তুর্কি ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করেছিলেন কি না। তাঁর বইটি প্রকাশ হওয়ার তিন বছর পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস)-এর প্রতিষ্ঠা হয়। ব্রিটিশ শাসকদের ইচ্ছায় বাবরনামা-র ইংরেজি সংস্করণ যখন প্রকাশিত হয়, তখন ভারতে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের উপক্রমণিকা নির্মিত হচ্ছিল, যা উপনিবেশবাদ-পুষ্ট ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিল।

যে ইতিহাসবিদরা রামজন্মভূমি মন্দিরের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান, তাঁদের কারও মনে কেন এ প্রশ্ন জাগল না যে, কী কারণে বেভরিজ বাবরের দিনলিপির সাড়ে পাঁচ মাস অনুবাদ করেননি? এই প্রশ্ন না ওঠাই আশ্চর্য, কারণ তুজ়ুক-ই-বাবুরি’র ফরাসি, রুশ ও আধুনিক তুর্কি ভাষায় অনূদিত সংস্করণে একটি পৃষ্ঠাও বাদ পড়েনি। যে সাড়ে পাঁচ মাসের কথা বলা হচ্ছে, তার অর্ধেকের বেশি বর্ষাকাল, যখন বাবরের সেনাদলকে সদর আগরা থেকে অযোধ্যায় যেতে হলে সৈন্যসামন্ত-হাতি-ঘোড়া সমেত প্রমত্ত নদী পেরোতে হত। তা কি সম্ভব ছিল?

তা হলে কি আদৌ মির বাকির নেতৃত্বে মোগল সৈন্য দল বর্ষায় স্ফীত সরযূ নদী পেরিয়ে অযোধ্যায় গিয়েছিল? তুজ়ুক-ই-বাবুরি’র (বেভরিজ অনূদিত বাবরনামা নয়) ভূমিকা পড়লে আদৌ মনে হয় না বাবর কোনও ধর্মস্থান ধ্বংস করার কথা ভাবতেন। তাঁর প্রশাসনিক সদর আগরার আশেপাশে একটি হিন্দু মন্দিরও তাঁর আমলে বিক্ষত হয়নি। তাঁর বাহিনী দুঃসাহসিক অভিযানে দুর্গগুলি (যেমন চান্দেরি) দখল করে, কিন্তু ধর্মীয় উপাসনালয়গুলি ধ্বংস করার সঙ্গে জড়িত ছিল না। তিনি যদি অমুসলিম উপাসনালয়গুলি ধ্বংস করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতেন, তবে আজকের মথুরার অস্তিত্ব থাকত না, যা বাবরের রাজধানী আগরার নিকটেই ছিল। যে ভূমিকার কথা বলছি, তা চাঘতাই তুর্কি থেকে সরাসরি রুশ ভাষায় অনূদিত।

পূর্বতন সোভিয়েট ইউনিয়ন-অন্তর্ভুক্ত উজ়বেকিস্তানের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস ১৯৫৮ সালে তুজ়ুক-ই-বাবুরি রুশ ভাষায় অনুবাদের এক প্রকল্প রূপায়ণ করে। দায়িত্ব নেন অ্যাকাডেমিশিয়ান মিখাইল আলেকজ়ান্দ্রোভিচ সেলি। তাঁর মাতৃভাষা ছিল চাঘতাই তুর্কি। তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত ভাষাতাত্ত্বিক (ফিলোলজিস্ট), একাধিক ইউরোপীয় ও প্রাচ্য ভাষাবিদ। তিনি উজ়বেকিস্তানের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর প্রাচ্য বিদ্যাচর্চা বিভাগের প্রবীণ গবেষক ছিলেন। তাঁর অনূদিত বাবরনামে এক অতি সুপাঠ্য আত্মস্মৃতিকথা, যাতে কোনও অংশ বাদ পড়েনি। বাবরের ফারগানায় বাদশাহি জীবন যখন শুরু হয়েছিল, তখন তাঁর ১২ বছর বয়স। তখনই তাঁর পরাক্রম স্বীকৃত। কিন্তু তার চেয়েও তাঁর খ্যাতি ছিল মধ্য এশিয়ার সংস্কৃতির এক জন উচ্চশিক্ষিত স্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে। যেখানেই তিনি গিয়েছিলেন, সেই দেশগুলির ইতিহাস, জীবন, উদ্ভিদ এবং প্রাণিজগতের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ দেখা গিয়েছিল, যা তাঁর আত্মস্মৃতিকথাকে ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক মূল্য দিয়েছে।

আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র (এএসআই) অযোধ্যায় ১৮৮৯-৯১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে চোখ বোলালেই রামজন্মভূমির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই জরিপে কর্মরত প্রত্নতাত্ত্বিক এমন কোনও মূর্তি, ভাস্কর্য বা স্তম্ভ খুঁজে পাননি, যা অন্যান্য প্রাচীন শহরের স্থানগুলিকে চিহ্নিত করে। তা ছাড়া জৌনপুর বা অযোধ্যায় মির বাকির উপস্থিতি তুজ়ুক-ই-বাবুরি’তে উল্লিখিত হয়নি। স্মৃতিকথাতেও নেই। রামজন্মভূমি কি তা হলে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত এক কল্পকথা?

তাসখন্দ থেকে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়ায় বাবরকে এক প্রতিভাবান লেখক, শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বোদ্ধা, স্মৃতিচয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি ছিলেন এক উদারচিত্ত মানুষ। তিনি মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান এবং ভারতের মানুষের জীবনচর্চা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন। ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, গদ্য লেখক ও কবি হিসেবে বাবরকে নিয়ে বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রধান প্রাচ্য বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে অধ্যয়ন করা হয়। তার প্রমাণ বাবর-নামে’র নতুন ফরাসি অনুবাদ, যা প্যারিসে ইউনেস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮০ এবং ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

অনেকে মনে করেন, এমন বৌদ্ধিক এক ব্যক্তি কোনও মন্দির ধ্বংসের নির্দেশ দিতে পারেন না। সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে ১৯৫৮-র পরে প্রকাশিত বাবরনামে-র কথা আমাদের দেশের রুশ ভাষাবিদদের কারও চোখে পড়ল না কেন? তাঁরা যদি এ নিয়ে লিখতেন, তা হলে হিন্দুত্ববাদীরা অবাধে গোয়েবলসীয় পন্থায় ক্রমাগত মিথ্যাভাষণ করে যেতে পারত না।

শঙ্কর রায়, কলকাতা-৯৫

Patriarchal Society Women men
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy