শান্তনু রায়ের চিঠি ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ (৪-৮) নিয়ে কিছু কথা। বন্দে মাতরম্ সঙ্গীতে হিন্দু ভাব নেই, আনন্দমঠে সাম্প্রদায়িকতা নেই, বা বঙ্কিমচন্দ্র অসাম্প্রদায়িক ছিলেন— এ সব বলা সত্যের অপলাপ মাত্র। বন্দে মাতরম্ গানটির সূচনায় সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা মা-এর ভাবমূর্তিটিতে, বঙ্গদেশই হচ্ছে মাতৃকল্প। ‘মা’ এখানে নৈর্ব্যক্তিক ও অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু তার পরেই, ‘‘বহুবলধারিণীং... রিপুদলবারিণীং’’ ও ‘‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী’’ হিসেবে উপস্থাপিত ভাবমূর্তিটিতে হিন্দুধর্মীয় দুর্গাকে মাতৃকল্প হিসেবে হাজির করা হয়েছে। এবং ‘‘তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’’ স্পষ্টতই হিন্দু ধর্মীয় পৌত্তলিকতাকে সামনে এনেছে। গানটির স্পষ্ট হিন্দুধর্মের ভাবমূর্তিটি রবীন্দ্রনাথের চোখেও ধরা পড়ে।
গানটি পৌত্তলিক, ভারতের অনেকেই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করেন না, দুর্গা সর্বভারতীয়ও নন, বহু মানুষ দুর্গাপুজো করেন না। যেমন খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলিম, শিখ, বস্তুবাদী, মানবতাবাদী, নাস্তিক, অসুর-পূজক। এ নিয়ে তাঁদের আপত্তি থাকতেই পারে। তাঁদের উপর জোর জবরদস্তি করার অধিকার কারও নেই। এই জোর জবরদস্তি বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে।
হিন্দুত্ববাদীদের মান্য ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র স্বপ্ন দেখেন— ‘‘ভাই এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?’’ ব্রিটিশ অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, সীতারাম ও রাজসিংহ উপন্যাসগুলিতে, তাঁর রচিত ‘ভারতকলঙ্ক’ (১৮৭২) প্রবন্ধে, লক্ষ করা যায় হিন্দু জাতীয়তা স্থাপন, হিন্দু রাষ্ট্র গঠন, হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ, গোহত্যা বন্ধ করা থেকে শুরু করে মুসলমান গ্রামবাসীদের নির্বংশ করার জন্য মুসলিম বিরোধী উত্তেজক ভাষাচিত্র রচনা। ‘ভারতকলঙ্ক’-এর রচয়িতা আগ্রাসী হিন্দু জাতীয়তার উগ্র সমর্থক বঙ্কিমচন্দ্রের সচেতন মনোভাবেরই ফল, তা বলা কি অন্যায় হবে?
বঙ্কিম তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণ চরিত্র’, ‘ধর্ম ও সাহিত্য’ প্রভৃতি রচনার মধ্যে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতায় প্রাণ সঞ্চার করেছেন। ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তান ধর্মের অন্যতম নেতা ভবানন্দের মুখে তারই প্রতিধ্বনি শুনি, ‘‘এ নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে’’ (প্রথম খণ্ড: দশম পরিচ্ছেদ)। সত্যানন্দ বলিলেন, ‘‘আমরা রাজা চাইনা— কেবলমাত্র মুসলমানরা ভগবান বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশ নিপাত করিতে চাই।’’ (দ্বিতীয় খণ্ড: চতুর্থ পরিচ্ছেদ) ইত্যাদি। এগুলি বঙ্কিমচন্দ্রের সুস্পষ্ট মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক মানসিকতারই ফসল।
বঙ্কিমের রচনা থেকে সুস্পষ্ট ভাবেই দেখা যায় যে, তিনি ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার বদলে ধর্মকেই জাতীয় ঐক্যসূত্র বলে গণ্য করেন বলেই তাঁর রচনায় ভারতীয়= হিন্দু— এই সমীকরণে উপনীত হয়েছেন। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে বলেছেন, ‘‘আমি হিন্দু, তুমি হিন্দু... লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে। এই লক্ষ লক্ষ হিন্দু মাত্রেরই যাহাতে মঙ্গল, তাহাতে আমার মঙ্গল।... অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল, সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয়, আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয়, করিব।... পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিত হয়, তাহাও করিব।’’ এটা কি বঙ্কিমচন্দ্রের আগ্রাসী সত্তার স্বরূপ নয়?
মুহাম্মদ হেলালউদ্দীন
কলকাতা-১৩
চরকার সঙ্গীত
গৌতম চক্রবর্তীর ‘মোদীর বন্ধুরা কেন আলাদা’ (৪-৮) প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭)’ বইটিতে গাঁধীজি সম্বন্ধে লিখছেন, ‘‘সংগ্রামের একটা স্তরে পুঁজিপতিদের মধ্যে যাঁরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী তাঁদের সাময়িক সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন এ কথা সত্য, কিন্তু অনুচিত হয়নি। অন্তত চীনে মাও তা নিয়েছিলেন।’’ এ কথা ঠিক যে গাঁধী কখনওই পুঁজিবাদের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করেননি, কিন্তু আর এক খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ইন্ডাসট্রিয়ালাইজ়েশন ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে যা বলেছেন তার বাংলা তর্জমা করলে এই দাঁড়ায়— ‘‘গাঁধীর আদর্শ পুঁজিবাদী স্বার্থের প্রতিফলন ছিল না, কিন্তু পুঁজিপতিরা তাঁর কিছু ধারণায় আকৃষ্ট হয়েছিল।’’ গৌতমবাবু অম্বালাল সারাভাইয়ের কথা কয়েক বার বলেছেন। রম্যাঁ রলাঁ তাঁর ‘ভারতবর্ষ’ গ্রন্থে বলেছেন যে অম্বালাল এক বার তাঁর কাছে এসেছেন, তাঁর বক্তব্য গাঁধীজি অম্বালালকে বিলাসবস্ত্র উৎপাদনে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন, যাতে খাদি শিল্পের সঙ্গে মিল বস্ত্রের প্রতিযোগিতা না হয়।
একটি ঘটনা বলি। গাঁধীজি অম্বালালের বাড়িতে গিয়েছেন, তখন মোরাদ আলি বীণা বাজাচ্ছিলেন। অম্বালালের পত্নী গাঁধীকে জিজ্ঞেস করলেন ‘‘বীণা কেমন লাগল?’’ গাঁধীজি উত্তর দিলেন ‘‘খুবই মিষ্টি, কিন্তু আমার চরকার সঙ্গীতের মতো এত মিষ্টি নয়।’’
শান্তভানু সেন
শ্রীপল্লি, শান্তিনিকেতন
দুই কাহিনি
১৯১৫ সালে ভারতে ফেরার অল্প কালের মধ্যেই আমদাবাদের অদূরে সাবরমতীর তীরে ২৫ জনকে নিয়ে গড়ে উঠল গাঁধীর প্রথম সত্যাগ্রহ আশ্রম। কিছু দিনের মধ্যেই অন্ত্যজ ধেড় সম্প্রদায়ের দুদাভাই ও তাঁর স্ত্রী কন্যাকে আশ্রমে নিয়ে এলেন গাঁধী। ধেড়দের জীবিকা মরা গরু-মোষের চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করা। পত্নী কস্তুরবা থেকে শুরু করে, আশ্রমবাসীরা বিরূপ হয়ে উঠলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার আশ্রম-জীবনের সঙ্গী ভাইপো মগনলাল সাময়িক ভাবে আশ্রম ছাড়লেন। আশ্রমের পৃষ্ঠপোষক জনসমাজ আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ায় আশ্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হল। কিন্তু গাঁধী অনমনীয়। তাঁর মানসপটে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ইতিমধ্যেই গাঁথা হয়ে গিয়েছে— ‘‘অস্পৃশ্যতা বা ছুতমার্গ হিন্দুধর্মের অঙ্গ তো নয়ই, উপরন্তু হিন্দুধর্মে প্রবিষ্ট একটা পচনশীল পদার্থ, একটা ভ্রম, একটা পাপ...’’ অতএব এখনই, এখান থেকেই সেই সংগ্রাম জারি। ঠিক এই সময়েই অপ্রত্যাশিত ভাবে ১৩ হাজার টাকা নিয়ে তরুণ শিল্পপতি অম্বালাল সারাভাইয়ের আবির্ভাব।
পরবর্তী কাহিনি— ১৯১৮ সালের ১৫ মার্চ ভারতভূমিতে প্রথম গাঁধীর তিন দিনের অনশন। অনশন তাঁর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মিল-মালিক সেই অম্বালালের বিরুদ্ধেই। কেন? শ্রমিকরা ৩৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি চায়, মালিক ২০ শতাংশের বেশি দেবে না। শেষাবধি গাঁধীর মধ্যস্থতায় ধাপে ধাপে ৩৫ শতাংশ মেনে নেওয়া হয়। তৈরি হয় গুজরাতে প্রথম শ্রমিক ইউনিয়ন— আমদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন।
শেষ কথা, ‘‘গাঁধীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল বলেই বিড়লাদের বাড়িতে থাকতেও দ্বিধা করেননি’’, প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তির মধ্যে কোনও বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, মহান ব্যক্তির উদাহরণ টেনে যদি কেউ নিজ কর্মের সাফাই দেন, পূর্বোক্ত ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়। কোনও নেতার সঙ্গে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির ছবি ছেপে কাউকে দোষী বানানোর অতিসরলীকৃত প্রবণতা সমর্থনযোগ্য নয়। তা ছাড়া, রাজনৈতিক দলের ফান্ডে আর্থিক অনুদান নির্বাচন কমিশনের দ্বারা অনুমোদিত।
শৈলেন্দ্রনাথ মাইতি
এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর
অন্য ছবি
নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর ‘আরও সুরকার’ চিঠিতে বলা হয়েছে ‘ঝাঁসি কি রানি’ ছবিতে সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে বন্দে মাতরম্ গানটি গেয়েছিলেন।তথ্যটি ভুল। ‘আনন্দমঠ’ (১৯৫২) সিনেমায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই গানটির সুর দিয়েছিলেন।
পরমা রায়
ইমেল মারফত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy