Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

বধ্যভূমিতেও নিয়ম মেনে গণতন্ত্র আসে, মৃত্যুমিছিল থমকে দাঁড়ায়

মৃত্যু উপত্যকায় চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এই পান্ধারকৌড়া তালুকের আনাচকানাচে যেন মৃত্যুর আঁশটে গন্ধ! মহারাষ্ট্রের বিদর্ভের এই প্রান্তে নির্বাচনী আঁচ পোহাতে এসে কানে এল

মৃত্যু উপত্যকায় চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এই পান্ধারকৌড়া তালুকের আনাচকানাচে যেন মৃত্যুর আঁশটে গন্ধ

মৃত্যু উপত্যকায় চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এই পান্ধারকৌড়া তালুকের আনাচকানাচে যেন মৃত্যুর আঁশটে গন্ধ

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

মৃত্যু উপত্যকায় চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এই পান্ধারকৌড়া তালুকের আনাচকানাচে যেন মৃত্যুর আঁশটে গন্ধ! মহারাষ্ট্রের বিদর্ভের এই প্রান্তে নির্বাচনী আঁচ পোহাতে এসে কানে এল, আগের রাতেই আত্মঘাতী হয়েছেন ধনরাজ বলিরাম নওয়াতে।

তাঁর বাড়ি ওই তালুকেরই পাহাপাল গ্রামে। বাড়ির বাইরে অজস্র চটি-জুতো। জানা গেল, স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে ‘পাটোয়ারিবাবু’ এসেছেন তত্ত্ব-তালাশ করতে। সেখানেই শোনা গেল ধনরাজ-রচিত ‘এপিটাফ’-এর কথা: ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজে লেখা এপিটাফ, মরাঠিতে লেখা দু’পাতার সুইসাইড নোট। সেই নোট জানিয়ে দিয়ে গিয়েছে অনেক কিছুই, বিদর্ভ ও মরাঠাওয়াড়ার আরও অজস্র কৃষক যে ভাবে জানিয়ে গিয়েছেন। সব ছেড়ে চলে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেও মানুষ এত কথা গুছিয়ে বলে যেতে পারেন! কী লেখা ছিল ওই সুইসাইড নোটে?

তার আগে ছায়াভাউয়ের কথা বলা যাক। প্রৌঢ়া ছায়াভাউ আত্মঘাতী ধনরাজের স্ত্রী। ঘরের ভিতরে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছেন, সে দৃষ্টিতে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। তাঁর ডান দিকে ছেলে গজানন, বাঁ দিকে দুই মেয়ে। যেন স্বগতোক্তি করে চলেন ছায়াভাউ: ‘‘আর কিছু নেই আমার কাছে। ও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল ওয়ার্ধায়। বিয়েতে অনেক ধারদেনা হয়। তার পরে মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সময়েও অনেক টাকা ধার করে। ও যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল!’’

‘‘কেমন হবে না-ই বা কেন?’’ পাশ থেকে বলতে থাকেন ধনরাজের ভাইপো রাহুল। রাহুল সুরেশ নওয়াতে। রাহুলের ছোটকাকা ধনরাজ। রাহুল বলেন, ‘‘চার-সাড়ে চার লক্ষ টাকা দেনা ছিল কাকার। বাড়ির কোনও কিছু হলেই কাকাকে ধার করতে হত মহাজনের কাছ থেকে। তার উপর তুলোচাষের অবস্থা খুব খারাপ। কী ভাবে দেনা শোধ করবে, তা-ই ভাবত দিন-রাত। কেমন চুপ করে গিয়েছিল।’’

হা হা করা তীব্র রোদ পুড়িয়ে দিচ্ছে সব কিছু। তার মধ্যে মরাঠিতে লেখা নোট হিন্দিতে অনুবাদ করার সময় রাহুলের চোখের পাতা ভিজে যায় যেন। সেই সুইসাইড নোটে লেখা: ‘‘...উপরওয়ালা ভগবান সঙ্গে নেই। ব্যাপারী মূল্য দেয় না। প্রশাসন সাহায্য করে না।...আগের বছর ফসল পোকায় খেয়েছে। এ বার ফসল খেয়েছে প্রকৃতি। জল নেই।’’

এ ভাবেই কি গণতন্ত্রের পরীক্ষা নেওয়া যায়? ভোটের মরসুম প্রতিশ্রুতির মরসুমও বটে। চাষিদের ঋণ মকুবের বান ডেকেছে রাজ্যে রাজ্যে। যেন বকেয়া ঋণ মকুব করলেই কৃষকের দুর্দশার চির অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তব কি সেটাই?

নাগপুরে দেখা হল ‘বিদর্ভ জন-আন্দোলন সমিতি’র সভাপতি কিশোর তিওয়ারির সঙ্গে। তিন দশকেরও বেশি মহারাষ্ট্রের কৃষক অধিকার নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, ঋণ মকুব করাটা কোনও সমাধান নয়। তার থেকে অনেক বেশি প্রয়োজন ‘সিস্টেম’-এর বদল ঘটানো। সরকার নির্দিষ্ট ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিলেও এই সমস্যার সমাধান হওয়ার নয়। কৃষক সুদখোর মহাজনের কাছে যাবেই, তার কারণ প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক তাকে ঋণ দেবে না। ব্যাঙ্কের শর্ত মেনে ঋণ পেতে হলে সময়ে কৃষকের হাতে টাকা আসবে না। ব্যাঙ্কের দরজায় ঘুরে ঘুরে কৃষকের জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। আবার, মহাজনের ঋণ শোধ করতে গেলে কৃষকের মূলধনে টান পড়বে। ধীরে ধীরে ঋণের ফাঁস ঘিরে ধরবে। ঋণের চক্র থেকে বেরোতে না পারলে অপমানের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করা ছাড়া বিকল্প নেই। কৃষকের আত্মহত্যাকে আত্মহত্যা বলে মানতে নারাজ কিশোর। তাঁর মতে, এটা আসলে হত্যা।

‘বিদর্ভ‌ জনআন্দোলন সমিতি’র হিসেব অনুযায়ী, ১৯৯৭ থেকে ২০১৯-এর মার্চ পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। বিদর্ভের নাগপুর ও অমরাবতী ডিভিশনের মোট ১১টি জেলা জুড়েই কমবেশি মৃত্যুর ছায়া। মৃত্যুচিন্তাও হয়তো সংক্রামক!

এই বোধের কথাটাই বলছিলেন আকাশ ভাসাওয়াত। আকাশের সঙ্গে আলাপ হয় নাগপুর থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার দূরে যবতমাল জেলার তেলঙ্গ টাকলি গ্রামে ঢোকার সময়। তেলঙ্গ টাকলি গ্রামেই বাড়ি রামদাস অম্বরওয়াড়ের। ১৯৯৭-এর ডিসেম্বরে কীটনাশক খেয়ে অসময়ের মৃত্যুকে বরণ করে বাইরের পৃথিবীর নজর কেড়েছিলেন রামদাস। সেই প্রথম। তার আগে বিদর্ভের কৃষকের হাহাকারের কথা সে ভাবে বাইরের জগতে পৌঁছয়নি।

রামদাসের স্ত্রী সরস্বতীর বাইপাস সার্জারি হয়েছে মাস তিনেক। রামদাস যখন আত্মঘাতী হন, তাঁর তিন মেয়ের বয়স ছিল আট, পাঁচ ও তিন বছর। তাঁদের মাথার উপরে ঋণের বোঝা ছিল লাখ পাঁচেক টাকার। ঋণ শোধ না করায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে চায় ব্যাঙ্ক। অতএব, ভরসা সেই কীটনাশক!

যে মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছিল রামদাসকে সামনে রেখে, সেই মিছিলের শেষ এখন দেখা যায় না।

দেশজোড়া কৃষক আন্দোলনের মধ্যেই শুরু হয়েছে মর্যাদা ফিরে পাওয়ার ভিন্ন এক লড়াইও। কয়েক মাস আগে, গত ২১ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় ৮০ জন মহিলা জড়ো হয়েছিলেন দক্ষিণ মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানে। তাঁদের প্রত্যেকের কৃষক স্বামীই ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই বিধবাদের দাবি ছিল, মহিলা কৃষিজীবী হিসাবে তাঁদের স্বীকৃতি দিক সরকার এবং যে জমিতে তাঁরা তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে চাষবাস করতেন, সেই জমির উপর তাঁদের অধিকার কায়েম করা হোক।

বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, খরাপ্রবণ মরাঠাওয়াড়া ও বিদর্ভ মিলিয়ে গত দু’দশকে ৬২ হাজারেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। মহিলা কৃষিজীবীদের নিয়ে যে সব সংগঠন কাজ করে, তাদের মূল সংগঠন ‘মহিলা কিসান অধিকার মঞ্চ’র (এম এ কে এ এ এম) করা সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ’১৮-র মধ্যে যে কৃষকেরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের স্ত্রীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ এখনও তাঁদের জমির উপরে অধিকার পাননি। অথচ, ওই জমিতেই বছরের পর বছর তাঁরা স্বামীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাষ করেছেন। এই সময়কালের মধ্যে যাঁরা তাঁদের স্বামীকে হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ মহিলা তাঁদের পারিবারিক ভিটের উপর অধিকার কায়েম করতে পেরেছেন। সমীক্ষাটি করা হয়েছে মরাঠাওয়াড়া এবং বিদর্ভের ১১টি জেলায়। মহারাষ্ট্রের এই জেলাগুলিই ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এখানে ৫০৫ জন মহিলার উপরে এই সমীক্ষা চালানো হয়। ভয়াবহ কৃষি বিপর্যয়ের জন্য তাঁদের স্বামীরা আত্মহত্যা করেছিলেন।

শাসক ও বিরোধী দলগুলির হুঙ্কারের মাঝে প্রান্তিক মানুষরা সবই দেখছেন, শুনছেন ও নিজেদের মতো করে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করছেন তাঁদের নিজস্ব ভাষায়। তাঁদের হাত ধরে তৈরি হচ্ছে এক ভিন্ন রাজনীতি, যার ভাষ্য স্পষ্ট। গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে এ এক নতুন কৃষক বিদ্রোহ!

এসেছিলাম নির্বাচনী উত্তাপ নিতে। ফিরছি একটা আলাদা উপলব্ধি নিয়ে। নির্বাচনী ইস্তাহার-প্রচার-বিজয়ী-বিজিত— এ সবের বাইরে এ এক ভিন্ন পৃথিবীর আখ্যান।

বধ্যভূমিতেও নিয়ম মেনে গণতন্ত্র আসে! মৃত্যুমিছিল থমকে দাঁড়ায়। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে সে মিছিলের সামনে থাকা রামদাস অম্বরওয়াড়ে মৃদু হেসে তাগাদা করেন, একটু পা চালিয়ে ভাই...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE