Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘ভোট দিয়ে যা, আয় ভোটার আয়’

দাদাঠাকুর অবশ্য প্রকাশ্যেই তাঁর ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ থেকে কার্তিকচন্দ্রের হয়ে গানে, ছড়ায় প্রচার শুরু করলেন। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার দাদাঠাকুরের পৈতৃক নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার দফরপুর গ্রামে। এখানে দাদাঠাকুরের কাছে রাজনৈতিক কারণে এক সময় আশ্রয় নিতে এসেছিলেন পরবর্তী কালের বিখ্যাত প্রাবন্ধিক, সুগায়ক, কৌতুক অভিনেতা, সম্পাদক  নলিনীকান্ত সরকার।

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ০১:০৪
Share: Save:

দাদাঠাকুর, এই নামেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক চেনে শরৎচন্দ্র পণ্ডিতকে। মুর্শিদাবাদের এই বরেণ্য রসিক মানুষটিকে নিয়ে লেখালেখি, চর্চা কম হয়নি। এখনও হয়ে চলেছে নিরন্তর। আসলে তিনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শিবরামের মতোই ফিরে ফিরে আসেন তাঁর কথার কারিকুরি, রস-রসিকতা নিয়ে। ভোট এলে আরও বেশি করে মনে পড়ে তাঁকে। এ সময়ে ভোট নিয়ে তাঁর মজাদার ছড়া, কীর্তি-কাহিনি পড়লে মন বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। বর্তমান ভোট-রাজনীতির আঁশটে হাওয়ায় দাদাঠাকুরের ছড়া যেন দখিনা বাতাস।

দাদাঠাকুরের পৈতৃক নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার দফরপুর গ্রামে। এখানে দাদাঠাকুরের কাছে রাজনৈতিক কারণে এক সময় আশ্রয় নিতে এসেছিলেন পরবর্তী কালের বিখ্যাত প্রাবন্ধিক, সুগায়ক, কৌতুক অভিনেতা, সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকার। আশ্রয় তো তিনি পেলেনই, দাদাঠাকুরের সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠল দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক। দাদাঠাকুর তাঁকে ডাকতেন নলে বলে। নলিনীকান্তের সঙ্গে দাদাঠাকুরের স্নেহের সম্পর্কে কখনও ছেদ পড়েনি। ‘বোতলপুরাণ’ আর ‘বিদূষক’ নিয়ে ফি সপ্তাহে দাদাঠাকুর কলকাতায় আসতেন। বিক্রি করতেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এ সময় নলিনীকান্তের পত্রিকা ‘বিজলী’র অফিসে এক বার ঢুঁ দিতে ভুলতেন না।

সে বার কলকাতা কাউন্সিলের নির্বাচনপালা চলছে। দাদাঠাকুর ‘বিজলী’র অফিসে আসতেই নলিনীকান্ত ধরে বসলেন সময়োপযোগী একটি রসরচনার জন্য। কাগজ-কলম নলিনীকান্তের হাতে। দাদাঠাকুর মুখে মুখে ছড়া বানাতেন, নলিনীকান্ত সেগুলো লিখে রাখতেন। এ বারেও সে রকম ব্যবস্থা। ভোট নিয়ে রসিকতা দাদাঠাকুরের বরাবরই প্রিয় বিষয়। তিনি মুখে মুখে বলে গেলেন একটি কবিতা। শিরোনাম—‘কর-পরশনে বিপরীত গীত’। যে কবিতাটি সব কালেই সব ভোটের ব্যাপারেই প্রাসঙ্গিক। কবিতাটির কয়েকটি লাইন—‘ঘৃণাব্যঞ্জক শব্দে যে ত্যানা কহে/ বলে-তেনুকাকা বাড়ি আছ হে!/ যিনি তস্কর-দলপতি দৈত্যগুরু,/ তিনি বাক্যদানে আজ কল্পতরু।’

আর এক বার দক্ষিণ কলকাতার উপনির্বাচন। প্রার্থী দুই সুরেন্দ্রনাথ। সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক এবং সুরেন্দ্রনাথ হালদার। সুরেন্দ্রনাথ হালদারের পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাশ। জিতলেন তিনিই। আবার ‘বিজলী’ পত্রিকার অফিস। আবার নলিনীকান্ত সরকার। এবং আবার সেই অনুরোধ— পত্রিকার জন্য সময়োপযোগী একটি রসরচনা লিখে দিতে হবে। দাদাঠাকুর লিখলেন—‘দক্ষিণ দুয়ারী উপনির্বাচন’। ‘দক্ষিণ কলিকাতা মুখরিত আজি রে/ দে রণ, দে রণ বলি হাঁকিল স্বরাজী রে।’ এই কবিতার শেষে উপ-নির্বাচিনের ফলাফলটিও লিখে দিলেন বেশ মজাদার ভাবে—‘হালদারের ফল হলো, মল্লিকেরো fail/ তবে কেন মিছিমিছি এত কোলাহল?’

দাদাঠাকুরের জীবনের আর একটি বড় কীর্তি তেলেভাজা ও চানাচুরের দোকানের মালিক কার্তিকচন্দ্র সাহাকে জঙ্গিপুর মিঊনিসিপ্যালিটির কমিশনার করা। কার্তিকচন্দ্র ছিলেন সদানন্দ, সাহসী, স্পষ্টবাদী এক মানুষ। দাদাঠাকুর কার্তিকচন্দ্রকে খুব ভালবাসতেন। ডাকতেন ‘কাত্তিকে’ বলে। সে বার কার্তিকচন্দ্রের ত্রৈমাসিক ট্যাক্স মিউনিসিপ্যালিটি এক ধাক্কায় তিন আনা থেকে বাড়িয়ে করে দিল ছ’আনা। এই বর্ধিত ট্যাক্সে স্বল্পআয়ী কার্তিকচন্দ্র স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুণ্ণ হলেন। শরণাপন্ন হলেন দাদাঠাকুরের। দাদাঠাকুর পরামর্শ দিলেন, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে। দরখাস্তও লিখে দিলেন। এক বার নয়,তিন তিন বার। কিন্তু কোনও কাজ হল না। দাদাঠাকুর তাঁর কাত্তিকে’কে বললেন—‘যাঁরা তোর দরখাস্তকে এ ভাবে অগ্রাহ্য করল সেখানেই বসাব তোকে। এই বর্ধিত ট্যাক্স দিয়েই বাজিমাত করব। তোকে মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার করব।’

সুযোগ মিলে গেল অচিরেই। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান পরলোকগমন করলেন। তিনি ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত। এই ওয়ার্ডে উপনির্বাচন শুরু হল। সে সময় নিয়ম ছিল, যে বছরে দেড় টাকা ট্যাক্স দেয়, সে-ই মিঊনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে কমিশনারের পদপ্রার্থী হতে পারে। কার্তিকচন্দ্রের ত্রৈমাসিক ট্যাক্স ছ’আনা হওয়ায় বাৎসরিক সেটা দেড় টাকায় দাঁড়িয়েছে। সুতরাং কার্তিকচন্দ্রের প্রার্থী হতে বাধা রইল না। তেলেভাজা-চানাচুরের দোকানের মালিক ভোটে প্রার্থী হয়েছে শুনে সারা শহরে সাড়া পড়ে গেল। বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাঁর বিরুদ্ধে কার্তিকচন্দ্র কার পরামর্শে দাঁড়িয়েছেন, তা জানতে শহরের কারও বাকি থাকল না।

দাদাঠাকুর অবশ্য প্রকাশ্যেই তাঁর ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ থেকে কার্তিকচন্দ্রের হয়ে প্রচার শুরু করলেন। লিখলেন ভোটের গান, ছড়া। এই গান-ছড়ার মধ্যে একটি তো ‘দাদাঠাকুর’ চলচ্চিত্রের সুবাদে বিখ্যাত। ‘ভোট দিয়ে যা-/ আয় ভোটার আয়/ মাছ কুটলে মুড়ো দিব/ গাই বিয়োলে দুধ দিব…।’ বিরোধী প্রার্থীর হয়ে, তাঁর বিরুদ্ধেই যায় এমন ছড়া ভোটের ইতিহাসে নতুন ও অভিনব। মহা সমারোহে শুরু হয়ে গেল নির্বাচন। ফল বেরোলে দেখা গেল বেশ ভাল ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন কার্তিকচন্দ্র।

‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ এ সম্পাদকীয়তে দাদাঠাকুর লিখলেন— ‘জঙ্গিপুর মিউনিসিপ্যালিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের অন্যতম কমিশনার বাবু ইন্দ্রচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার স্থানে জনৈক কমিশনার নির্ব্বাচনের দিন ছিল ২৮ শে জুলাই। প্রার্থী ছিলেন দুইজন।… শ্রীযুক্ত কার্ত্তিকচন্দ্র সাহা অধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত হইয়া কমিশনার নির্ব্বাচিত হইয়াছেন। এই নির্ব্বাচনে একটু আন্দোলন উত্থিত হইয়াছে, যেহেতু নির্ব্বাচিত ব্যক্তি শিক্ষিত বা ধনাঢ্য নহে।... করদাতাগণ যাহাকে যোগ্য মনে করেন তিনিই যোগ্য। শুধু কমিশনার হইলে হয় না, দেশের কাজ করিবার প্রবৃত্তি থাকা চাই। সব বন তুলসী ভাবে সব সে শিলা শালগ্রাম,সব পানি গঙ্গা ভাবে যব ঘটমে বিরাজে রাম। দেখা যাক সাহাজীর দ্বারা কি হয়’ (বানান অপরিবর্তিত)।

মিউনিসাপ্যালিটির ভোট আর লোকসভার ভোট নিশ্চয় এক নয়। কিন্তু ভোটের তরজায় সুস্থ রুচি, রসবোধ যে দরকার তা সব ভোটের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দাদাঠাকুর সেটাই দেখিয়েছেন তাঁর রচনায়, কর্মে।

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE