Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ভোটযন্ত্রের উপর মানুষের বিশ্বাস দৃঢ় করা প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব

এ বার যন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা

সাধারণ ভোটারকে অবশ্য ব্যালট ধরিয়ে দিলে ব্যালটেই ভোট দেবেন, ইভিএম দিলে বোতাম টিপবেন, আর ভিভিপ্যাট স্লিপ বেরোলে এক বার দেখে নেবেন বড়জোর। আসলে সাধারণ মানুষ তো আর প্রযুক্তি বোঝেন না।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে তরজার আর শেষ নেই। কাগজের ব্যালট ছাড়িয়ে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র বা ইভিএম ব্যবহার শুরু হওয়া থেকেই অবিশ্বাসের এক আবহ ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর। ভোটে হারার পরে ইভিএম যন্ত্রের দিকে আঙুল তুলেছে প্রায় সকল প্রধান রাজনৈতিক দল, কোনও না কোনও সময়ে।

সাধারণ ভোটারকে অবশ্য ব্যালট ধরিয়ে দিলে ব্যালটেই ভোট দেবেন, ইভিএম দিলে বোতাম টিপবেন, আর ভিভিপ্যাট স্লিপ বেরোলে এক বার দেখে নেবেন বড়জোর। আসলে সাধারণ মানুষ তো আর প্রযুক্তি বোঝেন না। তাই নির্বাচন কমিশন যতই বলুক, ইভিএম যন্ত্রের ক্ষেত্রে বাইরে থেকে কারচুপি করা অসম্ভব, কিছু মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বোধ হয় থেকেই যায়। যে ক’জন প্রযুক্তিটা একটু-আধটু বোঝেন, যন্ত্রগুলির পেট কেটে দেখার কোনও উপায় তাঁদেরও নেই। উপায় নেই স্টেথোস্কোপ কানে দিয়ে ইভিএম-এর হৃৎস্পন্দন শোনার। জনমত তাই গড়ে ওঠে খানিকটা প্রতিষ্ঠান আর খানিকটা রাজনৈতিক নেতাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে। প্রতিষ্ঠান বলছে বটে, ইভিএম যন্ত্রগুলি একশো শতাংশ সৎ। কিন্তু রাজনীতিকরা প্রতিনিয়তই প্রশ্ন তুলে চলেছেন এই সততায়, বিশ্বাসযোগ্যতায়। এমনকি দস্তুরমতো আইআইটি থেকে পাশ করা প্রযুক্তিবিদ মুখ্যমন্ত্রীও যখন ইভিএম-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, প্রযুক্তিতে অজ্ঞ হরিমুদি, কিনু গোয়ালা, হেড অফিসের বড়বাবুর মনেও ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ভোটযন্ত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ উঁকিঝুঁকি মারবেই। এর উপর কখনও যদি বিদেশের মাটিতে বসে কোনও হ্যাকার দস্তুরমতো সাংবাদিক ডেকে দাবি করে যে, অতীতে নির্বাচনে হ্যাক করা হয়েছে ইভিএম, তা পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ঘোলাটে করে দেয়, সে তার বক্তব্য যতই অলীক, অবাস্তব হোক না কেন। আর এই অবিশ্বাসের বাতাবরণ গণতন্ত্রের পক্ষে একেবারেই অভিপ্রেত নয়।

তবু এমনি করেই ভোট আসে, ভোট যায়। ক্রমে ইভিএম-এ আসে ভিভিপ্যাট প্রযুক্তি। অত্যন্ত সহজ, কিন্তু কাজের প্রযুক্তি এটা। ভোটার কাকে ভোট দিল, তা প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে ইভিএম থেকে। ভোটদাতা দেখতে পেলেন, প্রিন্টটা সঠিক। কিন্তু তাঁর মনে সন্দেহ থাকতেই পারে যে, কাগজে ঠিকঠাক ছাপা হলেও ভোটযন্ত্রের স্মৃতির ভাণ্ডারে তেমনটাই জমা হল তো! বা, এখন জমা হলেও যন্ত্রের স্মৃতিটাকে পরে কোনও সময়, ভোট-গণনার আগে, কোনও ভাবে বদলে দেওয়া হয়নি তো?

ভিভিপ্যাট-এর যুগে এটা যাচাই করার পদ্ধতি কিন্তু বেশ সহজ। ভিভিপ্যাট স্লিপগুলি জমা থাকে ইভিএম-এর ভিতরেই। ভোটের পরে সেগুলিকে গুনে-গেঁথে ইভিএম-এর থেকে যান্ত্রিক উপায়ে পাওয়া বিভিন্ন প্রার্থীর ভোট-সংখ্যার সঙ্গে যাচাই করে নিলেই হল। দুটো গণনা মিলে গেলেই সেই বিশেষ ইভিএম-টি নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই থাকে না। পদ্ধতিটা সহজ, জনগণের বোঝার পক্ষেও বেশ। আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে কিছুতেই ইভিএম-এর অ্যানাটমি বোঝানো সম্ভব নয়। যদি বোঝানোও যায়, তবে যে ইভিএম-এ আমি ভোট দিয়ে এলাম তার হৃৎপিণ্ড, মস্তিস্ক, আর শিরা-ধমনীগুলি যে খানিকটা অন্য রকম ছিল না, সেটা কী ভাবে বোঝা যাবে? তার চাইতে অনেক কার্যকর হল ভিভিপ্যাট-এর স্লিপ গুনে ইভিএম-এর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাওয়া বিভিন্ন প্রার্থীর ভোট-সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। প্রতিনিয়ত। প্রতিটা নির্বাচনে। এ এক নিরন্তর অগ্নি-পরীক্ষা। এই আগুনে পুড়ে পুড়েই কিন্তু শুদ্ধ থাকতে পারে গণতন্ত্র।

কিন্তু সমস্ত ইভিএম-এর ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনতে গেলে তো ঢাকের দায়ে মনসা বিকানোর অবস্থা হবে। সে ক্ষেত্রে ইভিএম-এ ভোট করানোর উদ্দেশ্যটাই মাটি। এখানেই রাশিবিজ্ঞানের নমুনা সমীক্ষা আর সম্ভাবনা-তত্ত্ব হাজির। বেশ অল্প সংখ্যক ইভিএম-এর সঙ্গে তাদের ভিভিপ্যাট-গণনা মিলিয়েই বেশ বড়সড় নিশ্চয়তার সঙ্গে ধরে ফেলা যায় ইভিএমগুলিতে আদৌ কোন কারচুপি হয়েছে কি না। তবে এই ক্ষুদ্র অংশটা মোট ইভিএম-এর ঠিক কত শতাংশ, নমুনা সমীক্ষার পদ্ধতিটা ঠিক কী হওয়া উচিত, সে নিয়ে শুরু হল বিস্তর গন্ডগোল।

নির্বাচন কমিশন প্রতি বিধানসভা ক্ষেত্রে একটা করে ইভিএম-ভিভিপ্যাট মিলাতে চাইছিল বেশ কিছু দিন ধরে। সেটা দেশের মোট ইভিএম-এর আধ শতাংশেরও কম। এই প্রস্তাব মানতে আবার নারাজ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। মোট ২১টি দল সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছিল, অর্ধেক সংখ্যক ইভিএম-এর ভিভিপ্যাট গোনার জন্য।

নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য এবং ২১টি দলের সম্মিলিত বক্তব্য কিন্তু একেবারে উল্টোমুখী। এক জন রাশিবিজ্ঞানী হিসেবে আমি নিশ্চিত যে, এই ইভিএম-ভিভিপ্যাট মিলানোর সংখ্যাটা নির্ভর করা উচিত ইভিএম-এ সম্ভাব্য কারচুপির শতাংশ, আর কতটা নিশ্চয়তার সঙ্গে কারচুপি হওয়া অন্তত একটা ইভিএম খুঁজে পেতে চাই, তার উপরে। প্রতি বিধানসভা কেন্দ্রের ৪৫০-৫০০টি ইভিএম থেকে একটা ইভিএম নিলে সংশ্লিষ্ট লোকসভা কেন্দ্রে অন্তত একটা ইভিএম-ভিভিপ্যাটে গরমিল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম, যদি না কারচুপি হওয়া ইভিএম-এর অনুপাতটা খুব বেশি হয়। ও-দিকে রাশিবিজ্ঞানের নমুনা সমীক্ষার গাণিতিক দক্ষতা এত কম নয় যে, দেশের মোট ইভিএম-এর অর্ধেকটাই ভিভিপ্যাটের সঙ্গে মেলাতে হবে, যদি না কারচুপি হওয়া ইভিএম-এর অনুপাতটা খুবই কম হয়। তাই সমাধান-সূত্রটা এর মাঝখানে কোথাও থাকা উচিত, এটা পরিষ্কার।

যা-ই হোক, প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ প্রতি বিধানসভা ক্ষেত্রে পাঁচটি করে ইভিএম-কে ভিভিপ্যাট-এর সঙ্গে মেলাতে বলেছেন। তবে রাশিবিজ্ঞানের অঙ্ক কষে এই সমাধান-সূত্র বার হয়েছে কি না জানা নেই। মোটের উপর সঠিক ভাবেই আদালত বাড়াতে চেয়েছে ভিভিপ্যাট যাচাইয়ের পরিমাণ। কোর্ট অবশ্য মাথায় রেখেছে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য— ভিভিপ্যাট গণনা-সংক্রান্ত লোকজনের অভাব এবং এর ফলে নির্বাচনের ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কথা।

আমরা বরং একটু দেখে নিই, কোর্টের এই রায় ইভিএম-এর সম্ভাব্য কারচুপিকে কতটা নিশ্চয়তার সঙ্গে ধরতে পারবে। আর নির্বাচন কমিশনের বিধানসভা-পিছু একটি ইভিএম যাচাই-ই বা কতটা নিশ্চয়তায় ধরতে পারত ইভিএম কারচুপি। ধরা যাক, কোনও একটি লোকসভা কেন্দ্রে মোটামুটি ৩২০০-৩৩০০ ইভিএম রয়েছে, সাতটি বিধানসভায় বিভক্ত। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ইভিএম যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কারচুপি ধরতে পারার নিশ্চয়তা বাড়তে থাকবে কতগুলো ইভিএম-ভিভিপ্যাট মেলানো হচ্ছে সেই সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তবে এই বৃদ্ধিটা এক জটিল অঙ্কের মধ্য দিয়ে হয়, এবং তা অবশ্যই সরলরৈখিক নয়। অঙ্ক কষে দেখা যাচ্ছে, যদি কোনও লোকসভা কেন্দ্রে ২০ শতাংশ ইভিএম-এ কারচুপি করা হয়, নির্বাচন কমিশনের বিধানসভা-পিছু একটা ইভিএম-এর ফর্মুলাতে অন্তত একটা কারচুপি হওয়া ইভিএম ধরা পরার সম্ভাবনা ৭৯%। ও-দিকে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ৫টি ইভিএম-এর ফর্মুলায় সে ক্ষেত্রে অন্তত একটা কারচুপি হওয়া ইভিএম পাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯৬%। আবার যদি কোনও লোকসভা কেন্দ্রে কারচুপি হয় ১০ শতাংশ ইভিএম-এ, নির্বাচন কমিশন আর সুপ্রিম কোর্টের ফর্মুলাতে অন্তত একটা কারচুপি হওয়া ইভিএম পাওয়ার সম্ভাবনা দাঁড়াবে যথাক্রমে ৫২.২% এবং ৯৭.৫%। কারচুপির শতাংশ ৫ হলে, দু’টি সম্ভাবনা হবে যথাক্রমে ৩০.২% আর ৮৩.৫%। আর ২ শতাংশ ইভিএম-এ কারচুপি হলে, নির্বাচন কমিশন আর সুপ্রিম কোর্টের সম্ভাবনা দু’টি যথাক্রমে ১২.৯% এবং ৫০.১%। তাই মোটের উপর সুপ্রিম কোর্টের ফর্মুলায় নির্বাচন কমিশনের তুলনায় কারচুপি হওয়া ইভিএম ধরা পড়বে অনেক বেশি সম্ভাবনার সঙ্গে।

আসলে অযান্ত্রিক ভোটযন্ত্র যাতে ‘জগদ্দল’ পাথর না হয়ে ওঠে সেটা নিশ্চিত করা, এবং ভোটযন্ত্রের মতো গণতন্ত্রের এক প্রয়োজনীয় মাধ্যমের উপর জনগণের বিশ্বাস দৃঢ় করানো প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব। গণতন্ত্রে ভোটযন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রযুক্তির নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাই কিন্তু যথেষ্ট নয়। একই রকম গুরুত্বপূর্ণ জনগণেশের মধ্যে এই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রত্যয় সুদৃঢ় করা। হয়তো বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাই। অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলি এই বিধানসভা-পিছু ৫টি ইভিএম-এর অগ্নি-পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়, না কি তাদের অসন্তোষ থেকেই যায় অগ্নি-পরীক্ষাটাকে কঠোরতর করার অভীক্ষায়, সেটা জানতে হলে আমাদের বোধ হয় অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ২৩ মে পর্যন্ত।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE