Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

গল্পের গরু গাছে তোলার মধ্যেও রাজনীতি রয়েছে

বেশি পড়াশোনা করতে হবে না, স্মার্ট ফোন থেকে খুললেই জানা যায় সাধারণ কিছু তথ্য— র‌্যাডারের কী কাজ? ভারতে ইন্টারনেট পরিষেবা কবে প্রথম এসেছিল? ইমেল কী?

সুমন সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০২:৩০
Share: Save:

যে সময়ে বাংলাতে কম্পিউটার এসেছিল সেই সময়কার একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করা যাক।

আজকের দিনে যাঁরা স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করেন, তাঁদের কাছে হয়তো গল্পটা হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ডিরেক্টর, যিনি শুধু পয়সা আর ক্ষমতাবলে কলেজের ডিরেক্টর হয়েছেন, এক দিন সেই কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করছেন। সবাই তাঁদের দাবি জানাচ্ছেন। কম্পিউটার শিক্ষকেরা বললেন, ভাইরাস ঢুকে কম্পিউটারগুলো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছু অ্যান্টিভাইরাস কিনলে ভাল হত। এই শুনে তো ডিরেক্টরের মাথায় হাত। উনি বললেন, সমস্ত ঘরে এসি বসানো, সমস্ত কাঁচ বন্ধ তা-ও ভাইরাস ঢুকছে কী করে ? উনি নিদান দিলেন, শিক্ষকদের জুতো খুলে ঢুকতে এবং দরজা-জানলাগুলো ভাল করে বন্ধ করতে।

আজকে এই ঘটনা শুনলে হয়তো হাসি পাবে। কিন্তু সে দিন অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো কথাটা সত্যি। পুরনো কথা কিন্তু আজকে এটা বলার কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি বক্তব্যে যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ জুড়ে গত কয়েক দিন ধরে বিরাট শোরগোল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পুলওয়ামায় জঙ্গি হানার পর ভারত যখন প্রত্যুত্তর দিতে তৈরি তখন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একটু সমস্যা হয়েছিল। কী সেই সমস্যা? হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে যাওয়ার ফলে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা একটু দ্বিধান্বিত ছিলেন বিমান আক্রমণ করবেন কি না, তাই নিয়ে। তার পর প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টার মধ্যে ঢোকেন এবং তিনি বলেন— যেহেতু তিনি বিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু তাঁর সাধারণ বোধ দিয়ে মনে হয়েছে যেহেতু মেঘলা আকাশ, তাই প্রতিপক্ষের র‌্যাডারে ধরা পড়বে না এই অতর্কিত আক্রমণ। ব্যস, তিনি বললেন ‘এগিয়ে যাও’।

এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়ল একদল লোক। উনি যখন বলছেন, তখন নিশ্চিত এটাই সত্যি। কেউ যদি উল্টো কথা বলেন যে, র‌্যাডারের সঙ্গে মেঘের কোনও সম্পর্ক নেই, ওটা চলে বেতার তরঙ্গে তখনই রে-রে করে তাঁর দিকে তেড়ে যাওয়া। ‘তুমি প্রশ্ন করছ কেন? তার মানেই তুমি দেশদ্রোহী।’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নির্বাচন প্রায় শেষ পর্যায়ে। নেতা-মন্ত্রীরা একের পর এক কথা বলে চলেছেন। আর কে না জানে বেশি কথা বললেই বাজে কথা বলা হয়। তবে এই বাজে কথা বলার মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা বার্তা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। ঠিক একই রকম ভাবে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি ১৯৮৮ সালে ইমেল ব্যবহার করেছেন এবং ডিজিট্যাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছেন, যখন ভারতে ডিজিটাল ক্যামেরা বা সর্বস্তরে ইমেল চালুও হয়নি, তখন সেটাও কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন। যাঁরা মনে করেন যে হয়তো ছিল, উনি হয়তো ঠিকই বলছেন, তাঁরা কি একবারও খতিয়ে দেখেন না এই তথ্যটা সত্যি কি না? বেশি পড়াশোনা করতে হবে না, স্মার্ট ফোন থেকে খুললেই জানা যায় সাধারণ কিছু তথ্য— র‌্যাডারের কী কাজ? ভারতে ইন্টারনেট পরিষেবা কবে প্রথম এসেছিল? ইমেল কী? কবে থেকে ইমেলের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান সবার জন্য চালু হয়? এই তথ্য আজকাল যে কোনও মানুষের নাগালের মধ্যে। কোনও দিন যদি শোনা যায় নীল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদে নেমেছিলেন তখন চারিদিকে খুব অন্ধকার থাকার কারণে ওঁর নামতে অসুবিধা হচ্ছিল, তখন নরেন্দ্র মোদী ওঁকে মোবাইলে ফোন করেন এবং পরামর্শ দেন যে মোবাইলের টর্চ (ব্যাটারি) জ্বালিয়ে নামতে তা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কেন এই কথাগুলো বলা হয়?

আসলে এই কথাগুলো বলার মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য সাধন করা যায় একসঙ্গে। গত ৫ বছরে এটা অনস্বীকার্য যে এই গণেশের মাথা প্লাস্টিক সার্জারির প্রথম উদাহরণ, বা মহাভারতের সময়ে ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিল বা কর্ণের জন্ম হয়েছে আইভিএফ বা ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে কিংবা ক্যানসার সেরে যেতে পারে গোমূত্র পান করলে— এ রকম বহু কথা শাসকদলের নেতামন্ত্রীরা বলেছেন। কিন্তু কেন? কিছু মানুষ এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন বলেই এটা বলা হয়। কেউ কেউ এটা বিশ্বাস করতে ভালবাসেন যে জ্যোতিষীরা ঠিক বলতে পারেন অনেক কিছু। তাই তাঁদের এই জ্যোতিষী বাবাদের উপর অগাধ বিশ্বাস। ঘটনাচক্রে দেখা যাবে যে যাঁরা এটা বিশ্বাস করেন তাঁদের সংখ্যাই হয়তো বেশি। তাই গ্রামেগঞ্জে এঁদের প্রভাবও বেশি। এখনও বাংলার গ্রামেগঞ্জে খোঁজ নিলে ডাইন, তুকতাক, ঝাড়ফুঁকের ঘটনার খবর আসে। এই ঠগ জোচ্চোরদের উপরে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের সংখ্যাটাও কম নয়। হয়তো বা যারা বিশ্বাস করেন না তাঁদের চেয়ে বেশিই। এই মানুষেরা এই সব বিশ্বাস করতে ভালবাসেন। শুধু গ্রাম কেন, শহরের একাংশও এই কথা বিশ্বাস করেন। এখান থেকে শুরু হয় গুজব ছড়ানো। গল্পের গরু গাছে চড়ার কথা শুনলেও বাস্তবে এই ভাবেই এগুলো ছড়ানো হয়। মানুষের মধ্যে একটা ধারণা যদি তৈরি করে দেওয়া যায় যে ওই ‘নেতা’ কিংবা ‘মন্ত্রীর’ অসীম ক্ষমতা এবং তিনি সমস্ত কিছুতে পারদর্শী তা হলে সেই ধারণার জোরেই হয়তো বা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব। সেই ধারণা সেই নেতাকে এমন উঁচু স্থানে প্রতিষ্ঠা করে দেয়, যাতে মনে হয় সেই নেতাকে গণতান্ত্রিক ভাবে আর বোধ হয় হারানো সম্ভব নয়। এমন একটা ধারণা থেকেই জন্ম নেয় সেই বিশ্বাস যে ‘উনি’ মিথ্যা বলতেই পারেন না, ওঁর জন্যই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে আমরা উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছি এবং আবারও পারব ভবিষ্যতেও যদি ‘উনি’ জিতে আসেন। পারলে ‘উনিই’ পারেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে।

সুতরাং, যে বা যারা এটা ভেবে আনন্দ পাচ্ছে যে, এই অপবিজ্ঞান ছড়ানোর মধ্যে দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা একেবারেই মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। এই কথাগুলো বলার মধ্যে দিয়ে উল্টে এমন একটা ধারণা ধীরে ধীরে জনমানসের গভীরে প্রবেশ করানো হচ্ছে যে, এই নির্বাচনে হেরে গেলেও সেই ধারণা রয়ে যাবে। যতই শহুরে তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষজনের কাছে এই কথাগুলো হাস্যরসাত্মক মনে হোক, এর পিছনেও একটা রাজনীতি আছে। যতই কিছু মানুষ ভাবুক না কেন এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক কথা বললে ভারতের মতো এত বড় গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের অসম্মান করা হয়, কিন্তু এই রোগটার বীজ অনেক গভীরে পোঁতা। যখন ফ্রান্সের নোতরদামে আগুন লাগার পর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিমান করে কেন জল দেওয়া যায় না, এই প্রশ্ন তোলেন তখন আসলে দেশের সমস্ত মানুষের সাধারণ বোধকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। যখন বলা হয় গোমূত্র পান করলে ক্যানসার সারে, তখন দেশের ডাক্তারদের ভুমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। যখন বলা হয় বিমান বাহিনীর সেনাদের ‘তিনি’ নির্দেশ দিয়েছিলেন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকাকালীন আক্রমণ করতে, তখন সেনার সক্ষমতা নিয়েই যে প্রশ্ন ওঠে— সেটা ভাবা কি জরুরি নয়?

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই ছোট ছেলেটিকে আজ বড় প্রয়োজন ছিল যে প্রশ্ন করত— ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ কিন্তু আজকের সময়ে কি এমন কাউকে পাওয়া যাবে যে প্রশ্নটা করবে কিন্তু দেশদ্রোহী চিহ্নিত হবে না? না কি অজ্ঞানতা, অপবৈজ্ঞানিক চিন্তার দিকে আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ? নামে হবে ডিজিটাল কিন্তু কাজে হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন! সেটা সময়েই বলবে। আগামী প্রজন্ম কিন্তু প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত আমাদেরই করবে যখন ভারত সেই মিনি বাসের পরিচালকের কথামতো ‘আসতে আসতে পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন’এর রাস্তায় যাচ্ছিল, তখন আমাদের কী ভুমিকা ছিল? উত্তরটা কিন্তু আমাদেরই দিতে হবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE