Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বোমার ভয়ে ভোটকর্মী লুকোলেন খড়ের গাদায়

কিন্তু তাতেও রক্ষা নেই। বাড়ির সবথেকে প্রবীণ মহিলা বললেন, ‘এই ছেলে, তাড়াতাড়ি গাদা থেকে বেরিয়ে আয়। বাড়ির বোমাগুলোও তো ওই গাদাতেই লুকোনো আছে।’ লিখছেন কবিরুল ইসলাম কঙ্ক রাতের কথা না বলাই ভাল। একে অচেনা জায়গা, তার উপর মশা এবং বিভিন্ন পতঙ্গের উৎপাত।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০০:৩৭
Share: Save:

লোকসভা ভোটের বাদ্যি বেজে গিয়েছে। তার মানে আবার আর একটি ভোট। ভোটকর্মীদের আবার যেতে হবে। কমবয়েসি ভোটকর্মীরা এতে রোমাঞ্চ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু মাঝবয়েসি বা বেশিবয়েসি ভোটকর্মীদের অনুভূতি আলাদা। এখন অবশ্য ওল, কচু, মান, তিন-ই সমান। অর্থাৎ বিপদ সবারই সমান। নির্বাচন-ভীতি সবার মধ্যেই কাজ করে। ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকে একটা অব্যবস্থার কষ্টকর পরিস্থিতি। বিশেষ করে ভোটকর্মীদের কষ্ট, একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। ভোটের আগের দিন সকাল থেকে শুরু হয় এই যুদ্ধ। ভোটের জিনিসপত্র নিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে যাত্রা করতে করতে প্রায় বিকেল। আর যানবাহনের সে কী ব্যবস্থা! কারও ভাগ্যে সিমেন্ট বা বালি বহনকারী না পরিষ্কার করা ট্রাক। কারও ভাগ্যে গবাদিপশু পরিবহণকারী লরি। কারও ভাগ্যে আবার লজঝড়ে ট্রেকার। ভাগ্য ভাল হলে জোটে বাস। ভোটগ্রহণকেন্দ্র বা বুথে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত্রি। তার পরে সেই চিরন্তন প্রবাদ—ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে।

রাতের কথা না বলাই ভাল। একে অচেনা জায়গা, তার উপর মশা এবং বিভিন্ন পতঙ্গের উৎপাত। আর গ্রীষ্মে ভোট হলে তো কথাই নেই! একমাত্র কুম্ভকর্ণের কাছাকাছি হলে কেউ ঘুমোতে পারেন। সেই না ঘুমোনো বা অর্ধ-ঘুমন্ত রাত কাটিয়ে সাতসকালে ওঠা। সকাল ৬টার সময় চা খেয়ে, না খেয়ে মক ভোটিং-এর আয়োজন করা। ইতিমধ্যে বাইরে ভোটারদের লাইন পড়তে শুরু করে। ফলে সকাল ৭টায় শুরু হয়ে যায় মহারণ। তার পরে সারাদিন কী ঘটে তা বলে দেয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজগুলি। সুতরাং কমবেশি সবাই সে সব খবর জানেন। যা জানেন না, সেটাই বরং জানানো যাক। স্পর্শকাতর, অতি স্পর্শকাতর বুথ বলে একটা কথা আছে। সেখানে কী হয় তা ভোটকর্মীরা জানেন। চমকানি, চাবকানি থেকে শুরু করে কানের পাশে বিশেষ অস্ত্রের স্পর্শ সবই ঘটে থাকে। বিগত ভোটে আমার এক সহকর্মী শিক্ষকের অভিজ্ঞতা বললেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁদের বুথ দখল হয়ে গিয়েছে। হাতে, কাঁধে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বুথ দখলকারীরা প্রিসাইডিং এবং বিভিন্ন পোলিং অফিসারদের সাবধান করে দিয়েছে—‘আপনারা কিন্তু চুপচাপ বসে থাকবেন। যা করার তা আমরাই করে দিচ্ছি।’

গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট ব্যালটে হয়। সুতরাং বুথ দখলকারীরা অবাধে ছাপ্পা মারছে আর ব্যালট বাক্সে ফেলছে। এ ভাবে দেড়-দু ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরে আমার সেই কমবয়েসি সহকর্মী শিক্ষকের দারুণ খিদে পায়। তাঁর ব্যাগে আছে অনেকগুলি খোসা ছাড়ানো বাদামের প্যাকেট। তিনি আর থাকতে না পেরে সেগুলো বের করেছেন। একা তো আর খাওয়া যায় না। তাই সহ-ভোটকর্মীদের হাতেও একটি করে বাদামের প্যাকেট দিয়েছেন। বেজার মুখে বসে থাকা প্রিসাইডিং অফিসারের হাতে বাদামের প্যাকেট দিতেই তিনি বুথ দখলকারীদের দেখিয়ে বললেন, ‘ওঁদেরকেও কিছু প্যকেট দাও। ওঁরাও তো অনেকক্ষণ কাজ করছেন।’

এ তো গেল বুথ দখলের গল্প। আসল গল্প তো সেখানে যেখানে গুলিগোলা চলে, খুন কিংবা জখম হওয়ার ঘটনা ঘটে। ঠিক এই ভয়টাতেই বহু ভোটকর্মী ভোটে যেতে চান না। তাঁদের পরিবার, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, পরিজনদের কথা ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। কিন্তু উপায় তো নেই। ভোটে যেতেই হবে। নইলে শো-কজ, চাকরি নিয়ে টানাটানি ইত্যাদি তো আছেই। সেই সঙ্গে আছে টেনশন। সে যাইহোক, এই ঘটনাটি ঘটেছিল এক প্রিসাইডিং অফিসারের বুথে। অতি স্পর্শকাতর সেই বুথের চারদিকই বোমাতে ভর্তি। বলা বাহুল্য ভোট শুরুর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সে সব বোমা কার্যক্ষমতা দেখাতে শুরু করেছে। চারদিকে বিকট শব্দ, বারুদের গন্ধ আর ধোঁয়া। এরই মধ্যে একটি বোমা ভোটগ্রহণকেন্দ্র বুথের জানলা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে। এবং সেটা ফেটে যাচ্ছেতাই অবস্থা। প্রিসাইডিং অফিসার কোনওক্রমে দরজা দিয়ে বেরিয়ে দৌঁড়ে পালিয়েছেন। বুথে বোমাবাজি হলে প্রশাসন তো আর বসে থাকবে না। বড়, ছোট, মেজ, সেজ আধিকারিকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যত রকম বাহিনী আছে সব উপস্থিত। বুথের মধ্যে জখম পোলিং অফিসারদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রিসাইডিং অফিসারকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁকে কোথাও পাওয়া গেল না।

বোমাবাজি ঘটে যাওয়া বুথে ভোট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় বাহিনী টহল দিচ্ছে। গ্রামের লোকজনও সে ভাবে রাস্তায় নেই। সন্ধ্যায় সবাই বাড়ি ঢুকে গিয়েছেন। বাড়ির মহিলারা কেউ রাতের খাবার তৈরি, ছেলেমেয়েদের পরিচর্যায় ব্যস্ত। কেউ গরু, ছাগল, ভেড়াকে গোয়ালে তুলছেন। এক মহিলা গরু গোয়ালে তুলে দিয়েছেন। এ বার সাঁজাল দেবেন। গোয়ালের উত্তর দিকের কোনায় রাখা পাঠকাঠি এবং খড়ের গাদা। সেই পাটকাঠিতে হাত দিতে না দিতেই নড়ে উঠল গাদাটি। মহিলার আবার সাপের খুব ভয়। তাঁর চিৎকারে বাড়ির পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা নিয়ে গোটা পনেরো জন গোয়ালের সামনে হাজির। চার জন পুরুষ লাঠি নিয়ে প্রস্তুত। পাটকাঠি-খড়ের গাদায় লাঠি দিয়ে বার কয়েক গুঁতো দিতেই, সেখান থেকে বেরিয়ে এল কাতর কণ্ঠস্বর, ‘ওগো, আমাকে মেরো না গো। আমি প্রিসাইডিং অফিসার। বোমার ভয়ে এই গাদায় এসে লুকিয়েছি।’ এ বার শোনা গেল বাড়ির সবথেকে প্রবীণ মহিলার গলা, ‘এই ছেলে, তাড়াতাড়ি গাদা থেকে বেরিয়ে আয়। বাড়ির বোমাগুলো তো ওই গাদাতেই লুকোনো আছে ।’

বোঝো ঠেলা। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কিন্তু বাঘের উৎপাত ওখানেই শেষ নয়। সারা দিন ক্লান্তিকর পরিশ্রমের পরে ভোটের জিনিসপত্র জমা দেওয়া আর একটি যুদ্ধ। এই সব জমা-টমা দিতে সময়ের এবং নিজের বারোটা বেজে যায়। সবথেকে বেশি অপমানটা ঘটে এর পরেই। বাড়ি ফেরার যানবাহনের চূড়ান্ত অব্যবস্থা। ব্যাপারটা এই রকম, ‘আপনার ইচ্ছে হলে বাড়ি যান, না ইচ্ছে হলে যাবেন না।’ গত দু’দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে, বাড়ি ফিরতে চাওয়া ভোটকর্মীদের আর মানুষ বলে মনে করা হয় না। গণতন্ত্রের কাজ তো মিটে গিয়েছে! শেষতক বহু কষ্টে ঘরে ফেরা। এত কিছুর পরেও ভোট করতে শুধু ভোটকর্মীরাই পারেন!

শিক্ষক, দেবকুণ্ড পূর্বপাড়া

প্রাথমিক বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE