Advertisement
১১ মে ২০২৪

হরিপদ সেই চায়ের দোকানেই, প্রতিশ্রুতির ঢল ভোটের সভায়

প্রতিবারের মতো এ বারও বন্যা বয়ে যাচ্ছে ভোটের প্রতিশ্রুতির। বহু কিছুর আশ্বাস মিলছে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার বদল নিয়ে কেউ কিছু বলছেন কি? লিখছেন জয়দেব সাহাগল্পটা সেদিনও ছিল। গল্পটা আজও আছে। শুধু ঘটনা একটু অন্য রকমের।

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ১০:৫৪
Share: Save:

গল্পটা একটি প্রত্যন্ত গ্রামের। সময়টা নব্বইয়ের দশক। চারিদিকে নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। একটা গমগম ভাব গ্রামের উঠতি বাসিন্দাদের মধ্যে। তাদেরই একজন হরিপদ। বয়সটা সতেরো-আঠারো হবে। বাবা আর কাকা মিলে একটা চুলদাড়ি কাটার দোকান চালান। অভাবের সংসারে সামান্য আয়ে কোনও মতে সংসার চলে। আশপাশে যেখানেই কোনও রাজনৈতিক সভা হয়, ভিড়ের মধ্যে হরিপদের মুখ। রাজনৈতিক সভায় হরিপদ যাবেই। আর বাড়ি ফিরে গল্প শোনাবে— ‘আজ ওই নেতাকে নিজের চোখে দেখলাম। সামনের সারিতে বসে ছিলাম তো!’ তার কাকার ছেলে অবশ্য তখন উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গল্পটা সেদিনও ছিল। গল্পটা আজও আছে। শুধু ঘটনা একটু অন্য রকমের। একটু পরিবর্তন। হরিপদ এখন বড় হয়েছেন। পারিবারিক দোকানটায় সারাদিন বসে থাকেন। আর সময় হয় না তাঁর সভায় যাওয়ার। বাবা বুড়ো হয়েছেন, তবু মাঝে মাঝে দোকানে ভিড় হলে হাত বাড়ান। আর কাকার ছেলে এখন শহরের কলেজে পড়ায়। কাকাকে নিয়ে শহরেই থাকে। প্রশ্নটা হল— পরিবর্তনের মাপকাঠি তা হলে কী? কে আনবে উন্নয়ন?

নেতা-মন্ত্রীদের বড় বড় ভাষণে বোধ হয় কোথাও একটা খামতি থেকে যায়। শিক্ষা ছাড়া সব প্রতিশ্রুতিই তাঁরা দিয়ে থাকেন। ভাগ্যিস হরিপদের কাকার ছেলেটার সভায় সভায় ঘুরে বেড়ানোর নেশা ছিল না। চায়ের দোকানে আড্ডা মেরে রাজনৈতিক গল্প করারও নয়। তা হলে দাদা হরিপদের ছেলেটার পড়াশোনা চালানোর জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেও পারতেন না হয়তো।

উন্নয়ন আর পরিবর্তনের আবেগভরা বক্তৃতায় আর কতদিন হারিয়ে যাবে সাধারণ মানুষের উন্নতির স্বার্থ? খেটে খাওয়া মানুষ কতদিন আর নিজের ভাল ভুলে গিয়ে আবেগে ভেসে বেড়াবেন? উন্নয়ন কে আনবে? মাধ্যমিক-উত্তীর্ণ রাজনৈতিক নেতা, না কি উপযুক্ত শিক্ষা? বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি শুনতে আর কতদিন মানুষ অভ্যস্ত হয়ে থাকবেন? নেতা-মন্ত্রীদের ভাষণ যখন তাঁদের আবেগে ধাক্কা দেয়, তখন কি একবারও তাঁরা বলবেন না— ‘আগে তোমরা আমার গ্রামের স্কুলটা তৈরি করে দাও, তবে ভোট দেব। নেশাবস্তু আর টাকা নিয়ে কী করব! ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারি যাতে, আগে তার ব্যবস্থা করে দাও দেখি!’

যে রাজনৈতিক দলই হোক বা নেতাই হোন, উন্নয়নের নামে প্রদত্ত হাজারো প্রতিশ্রুতির মধ্যে পরিবর্তনের আসল ভাবনাটাই গুলিয়ে যায়। তাই হয়তো যে লোকটা রেলস্টেশনে চা বিক্রি করেন, তিনিও নিজের ছেলেকে আর গ্রামের কার্যত-করুণ প্রাইমারি স্কুলে পাঠান না, তার বদলে এক বেলা না খেয়েও নার্সারি স্কুলে ভর্তি করান। কয়েকবছর পর সরকারি হাইস্কুলগুলোরও যে ওই একই দশা হবে না, সে প্রতিশ্রুতি কে দিতে পারবেন! কিন্তু কার কী আসে যায় তাতে! সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে ক’জন কর্ম বা পেশার জগতে বা ভাবনার ক্ষেত্রে সাফল্য পেল, তাতে কার কী! ক’জন বড় সংস্থায় চাকরি পেল, এ সব ভেবে সাধারণ মানুষের কী! কিন্তু গ্রামের কৃষকও তো সন্তানের জন্মের পর আশা করে যে, তাঁর সন্তান খুব পড়বে-লিখবে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কে যে তাঁদের মন থেকে এই সংকল্পগুলো মুছে দেয়!

নির্বাচনের লগ্নে মিথ্যে ভাবাবেগ দিয়ে কি পরিবর্তন আনা সত্যিই সম্ভব? না কি একে অপরকে দোষারোপ করে বিকাশ আসতে পারে? গ্রামের স্কুলগুলোয় যোগ্য শিক্ষক নেই। যে সমস্ত স্কুলে বিজ্ঞান পঠনপাঠনের ব্যবস্থা আছে, সেখানে এমন পরিষেবা বা প্রশিক্ষক নেই যে, ছেলেমেয়েগুলো উপযুক্ত ভাবে তৈরি হয়ে উঠতে পারেব। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ কিছু পাঠ্য বিষয় নিয়ে ভয় কাজ করে। সে ভয় কাটানোর উপায় নেই অনুপযুক্ত ব্যবস্থার। অভিভাবকেরাও খবর রাখেন না যে, সন্তানের পড়াশোনার অবস্থাটা ঠিক কেমন। ছেলে বা মেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে বলে রাস্তাঘাটে গ্রামীণ নাগরিক অনেক সময়ই হয়তো বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ান, কিন্তু খোঁজ নেন না যে, আদতে পড়াশোনাটা সন্তান ঠিকমতো করে উঠতে পারছে কি না। খোঁজ নিলে হয়তো নির্বাচনের হালহকিকত বদলে যেত! কেন উচ্চ মাধ্যমিকের কোনও পড়ুয়াকে পাঁচটা টিউশন নিতে হবে! স্কুলের সামর্থ্য নেই পড়ানোর? তা হলে স্কুল রাখার কি দরকার! অনলাইন ফর্ম ভরে পরীক্ষা দিলেই তো চলে! কেন স্কুলে নাম লেখাতেই হবে, যখন পড়তে হবে কোচিং সেন্টারে? কে দেবে এর জবাব? আর জবাব চাইবেই-বা কে? জং ধরা শিক্ষাব্যবস্থা সমাজটাকে খেয়েই চলে যাচ্ছে, অথচ কারও মাথা ব্যথা নেই! গ্রামে মন্দির-মসজিদ হল কি না, তা নিয়েই চলছে দিনের পর দিন চর্চা!

পাঠ্যবইয়ে পড়ুয়া পড়ছে কোন মাটিতে কোন শস্য ভাল হয়। তার সঙ্গে কি এটা পড়ান যেত না যে, কারা এই শস্য চাষ করেন? আমাদের ব্যবস্থা ধরেই নিচ্ছে যে, এটা ওরা জানে। জানা আর অনুভব করার মধ্যে ফারাক আছে। তাই বড় ঘরের যে ছেলেটা ভুট্টা খায়, ফুটপাতে ভুট্টা-বিক্রেতাকে দেখে বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘উফ! হাঁটার উপায় নেই! এরা ফুটপাতও নোংরা করে রেখেছে!’ অথচ, ভুট্টার খোসাটা সে ছেলে হয়তো নিজেই ডাস্টবিনে না ফেলে ফুটপাতে ফেলেছে। ছেলেটার মনে এমন ভাবনা কে ঢোকাচ্ছে? শিক্ষাব্যবস্থা যদি সাধারণ মানুষের পরিশ্রমের বাস্তবতাটা তুলে ধরত পড়ুয়ার কাছে, তা হলে হয়তো এমন ঘটত না! কিন্তু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে নেই শিক্ষাব্যবস্থার সেই জরুরি পরিবর্তনের কথা!

শিক্ষাকে কর্মমুখী করা গেলে হয়তো বেকারত্ব নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি-তালিকায় থাকই না! মন্ত্রীদের ভাষণে থাকে বেকারত্ব নিয়ে বড় বড় কথা। থাকে না এই সামান্য কথাটা যে, পড়ুয়াকে দক্ষ করে তুলতে হবে, এমন শিক্ষাব্যবস্থা দরকার। ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়েদের অনেকেই যে কাজের যোগ্যই নয়, সমীক্ষায় সেটাও অনেকবার উঠে এসেছে। কিন্তু তাতে কে কান দেবে? পরিবর্তনের কুশীলবেরা তো চা-দোকানে, বাসে-ট্রেনে উন্নয়নের গল্প করতেই ব্যস্ত!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Promise
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE