মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়াছে। পর্ষদ তাহাতে বিচলিত নহে। পর্ষদ সভাপতি বলিয়াছেন, জন্মহার কমিতেছে, তাই পরীক্ষার্থীও কমিতেছে। ভাগ্য ভাল, তিনি এই উত্তর দিয়াছেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এই উত্তর লিখিলে নম্বর কাটা যাইত। ২০১৯ সালে মাধ্যমিকে বসিতেছে সাড়ে দশ লক্ষের কিছু অধিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু দশ বৎসর পূর্বে প্রথম শ্রেণিতে ছিল, সরকারি হিসাবেই, ছাব্বিশ লক্ষ শিক্ষার্থী। তাহাদের মধ্যে ষোলো লক্ষ উঠিয়াছিল পঞ্চম শ্রেণিতে (২০১৩)। এই হিসাব রাজ্য সরকারের। পশ্চিমবঙ্গে জন্মহার কমিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমিবার কারণ তাহা নহে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা না বাড়িবার কারণ, স্কুলছুটের সংখ্যা যথেষ্ট কমে নাই। প্রতি বৎসরই দেখা যায়, প্রথম শ্রেণি হইতে দশম শ্রেণির মধ্যে এ রাজ্যের সাত লক্ষ ছাত্রছাত্রী ‘উধাও’ হইয়া যায়। স্কুল পরিকাঠামোর উন্নয়ন, অধিক শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন অনুদান, কিছুই তাহাদের স্কুলের পরিধিতে রাখিতে পারে নাই। অতএব গত বৎসরের তুলনায় আঠারো হাজার পরীক্ষার্থী কমিল কেন, ইহা ছোট প্রশ্ন। বড় প্রশ্ন এই যে, এই বৎসরও কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে কেন মাঝপথে হারাইল রাজ্য? এই বৃহৎ প্রশ্নের দৃষ্টিতে দেখিলে জন্মহার কমিবার অজুহাতটি কেবল ভ্রান্ত বলিয়া অবজ্ঞা করা যায় না। আশঙ্কা হয়, পর্ষদ কি তবে দায় এড়াইবার সুযোগ করিয়া দিতেছে শিক্ষা দফতরকে? ‘জন্মহার কমিতেছে’ শুনিলে মনে হয়, পরীক্ষার্থী কমাই স্বাভাবিক। বাস্তব কিন্তু তাহার বিপরীত।
প্রতি বৎসর পঞ্চাশ হাজার পরীক্ষার্থী বাড়িলেও চৌদ্দ বৎসর লাগিবে সকল শিক্ষার্থীকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আনিতে। অথচ পরীক্ষার্থী বাড়ে নাই, বরং কমিতেছে। রাজ্যবাসী প্রশ্ন করিতে পারেন, তামিলনাড়ু যাহা পারিয়াছে, তাহা পশ্চিমবঙ্গ কেন পারিবে না? সেই রাজ্যে পঞ্চম শ্রেণি হইতে দশম শ্রেণির মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু অধিক। তামিলনাড়ুর জনসংখ্যা দুই কোটি কম, কিন্তু পরীক্ষার্থী পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমান। এতটা সাফল্য পশ্চিমবঙ্গ কবে অর্জন করিবে, সেই প্রশ্ন উঠিবে বইকি। সরকারি প্রচার আর সরকারি তথ্য যখন দু’টি বিপরীত চিত্র নির্মাণ করে, তখন গুরুত্ব দিতে হইবে তথ্যকেই। কন্যাশ্রী প্রকল্প আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাইতে পারে। কিন্তু রাজ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বালিকা-কিশোরী এখনও স্কুলের বাহিরে। ‘ইউনিসেফ’ সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতের যে রাজ্যগুলিতে নাবালিকা বিবাহের হার সর্বোচ্চ, তাহাদের মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গ। অতএব মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বাড়িলে আশ্বস্ত হইবার কারণ নাই।
বরং প্রশ্ন করিতে হইবে, কেন ছাত্রদের সংখ্যা বাড়ে নাই? ছেলেদের ফিরাইতে কী করা প্রয়োজন? স্কুলছুট হইবার কারণ বিচিত্র ও জটিল। কাজে নিয়োগের সম্ভাবনায় সংশয় হইতে অতি-দারিদ্র, পারিবারিক হিংসা, শিশুশ্রমিকের চাহিদা এই সকলই আছে তাহার মধ্যে। শিক্ষার মানও একটি মৌলিক প্রশ্ন। অনুদানের সংখ্যা ও অর্থ বাড়াইয়া এই সকল সমস্যার সমাধান হইবে না। সমস্যা কী, তাহার নির্ণয় এবং নির্দিষ্ট সমাধান প্রয়োজন। কারণ, সব শিশু স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ না করিলে তাহা রাজ্যের তথা দেশের অপূরণীয় ক্ষতি। জন্মহারের তারতম্য ভুলিয়া, শিক্ষাকর্তারা স্কুলছুটের হার লইয়া মাথা ঘামাইবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy