Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

পাত্র গৃহকর্মনিপুণ

বলিউডি সিনেমা ‘কি অ্যান্ড কা’ নিয়ে এল ‘হাউস-হাজব্যান্ড’-এর ধারণা। সংসার-সামলানো পুরুষকে গ্রহণ করতে আমরা তৈরি কি? হা উস-হাজব্যান্ড? ‘বক্‌ওয়াস ফিলোসফি!’ এ তো জীবনভর পরিশ্রম থেকে বাঁচবার একটা পন্থা মাত্র। বিল্ডার-বাবার রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন না দেখে, কী করে নিজের হাউজওয়াইফ মায়ের মতো ঘরে বসে থাকবে কবীর?’— তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করিনা কপূর ওরফে কর্পোরেট ‘কিয়া’— ‘কি অ্যান্ড কা’ চলচ্চিত্রের ‘কি’-র।

স্বাতী বসু
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০০:০২
Share: Save:

হা উস-হাজব্যান্ড? ‘বক্‌ওয়াস ফিলোসফি!’ এ তো জীবনভর পরিশ্রম থেকে বাঁচবার একটা পন্থা মাত্র। বিল্ডার-বাবার রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন না দেখে, কী করে নিজের হাউজওয়াইফ মায়ের মতো ঘরে বসে থাকবে কবীর?’— তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করিনা কপূর ওরফে কর্পোরেট ‘কিয়া’— ‘কি অ্যান্ড কা’ চলচ্চিত্রের ‘কি’-র।

‘মা ঘরে বসে থাকত না, ঘর তৈরি করছিল। সে-ও কি কোনও বড় ব্যবসার থেকে কম? বরং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্ট— নিজের জন্য কোনও স্বপ্ন না-দেখার আর্ট। মা যা করত, তার কোনও লম্বা-চওড়া ডেজিগনেশন ছিল না ঠিকই, ভিজিটিং কার্ডও ছিল না, মাস গেলে ব্যাংকে টাকাও জমা হত না। তাই বলে মা শুধু-শুধু ঘরে বসে থাকত না!’ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দেয় অর্জুন কপূর ওরফে ‘কবীর’— ‘কি অ্যান্ড কা’-র ‘কা’।

আমরা বরাবর মায়েদের কাজকে, সংসার করার নিরলস প্রচেষ্টাকে ‘থ্যাংকলেস’ কাজ বলেই জেনে এসেছি। সে কাজকে এ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আজকের এক যুবক? এবং মায়ের দ্বারা সে এতটাই অনুপ্রাণিত হচ্ছে যে গোটা জীবন হোম-মেকার থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলছে! কবীরের এই ভাবনা বাড়াবাড়ি মনে হতেই পারে, তবে এও তো ঠিক: সিনেমা সমাজেরই আয়না। ইদানীং ভারতে কিছু কিছু কবীর বিচরণ করছে। এবং, তাদের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।

লেখক চেতন ভগত বহু বছর আগে একেবারে মাইক-হাতে নিজের স্টে-অ্যাট-হোম হাজব্যান্ড স্টেটাস ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার স্ত্রী যখন ইউবিএস (সিঙ্গাপুর) ব্যাংকের সিওও হয়ে গেল, আমি চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে এলাম। ওই সময়টায় ও রীতিমত সফল, আমি নই। তাই চাকরিতে ইস্তফা দিতে দ্বিধা করিনি। এখন কোনও সমস্যা নেই, বরং দুই ছেলেকে নিয়ে ভালই কাটছে সময়।’ এর কিছু দিন পরে কানে এল পেপসিকো-র সিইও ইন্দ্রা নুয়ি-র কথা। তাঁর স্বামী রাজকিষণ নুয়ি পূর্ণ সময়ের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন প্রধানত তাঁদের দুই মেয়েকে ভাল ভাবে মানুষ করার জন্য। নুয়ি-দম্পতি কি ইচ্ছে করলেই মেয়েদের জন্যে বড় গভর্নেস রাখতে পারতেন না? কিংবা নামী-দামি আবাসিক স্কুল কি ছিল না? কিন্তু তাঁরা সে পথ নিতে চাননি।

স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে যাঁর চাকরিতে সম্ভাবনা এবং নিশ্চয়তা বেশি, তিনি তাঁর পেশায় শতকরা একশো ভাগ নিমজ্জিত থাকলেন, আর অন্য জন বাড়ি দেখাশোনার পাশাপাশি ইচ্ছে করলে আংশিক সময়ের কাজে নিযুক্ত হলেন— এর বিকল্প হয় কি? হ্যাঁ, এত দিন শুধু মেয়েরাই চাকরি বলি দিয়ে এসেছেন, এখন পুরুষেরাও যদি খোলা মনে, নির্ভেজাল আন্তরিকতার সঙ্গে ‘স্ত্রী’ বা ‘মা’-এর ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হন, সমস্যা কী?

বলিউডে কর্মরত বন্ধু পূবালী বলছিল, ওখানে অভিনয় বা অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত দম্পতিদের মধ্যে অহরহ এই ভূমিকা-বদল ঘটছে, বিশেষ করে তারা যখন বাবা-মা হচ্ছে। যার হাতে যখন কাজ, তখন সে সংসারের দায়িত্ব থেকে ‘অফ’ হয়ে যায়। অন্য জন তখন ২৪x৭ সন্তানের জন্য নিবেদিত। সন্তান প্রতিপালনে বেতনভোগী সহায়িকার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, বরং নিজেরাই তাদের মানুষ করার এই চেষ্টাকে কুরনিশ জানাতেই হয়! মুম্বই ফিল্ম জগতেরই সফল ডিজাইনার এবং সিংগল-মাদার সুবর্ণা বলছিলেন, ‘যদি নতুন সম্পর্ক গড়বার সুযোগ আসে, অবশ্যই হাউস-হাজব্যান্ড প্রেফার করব। কারণ আমার পেশায় কাজের কোনও ধরাবাঁধা সময় নেই।’

‘মেল ইগো’র পরোয়া না করে আমাদের দেশে যে পুরুষেরা স্ত্রীকে তাঁদের স্বপ্ন-পূরণের রাস্তায় এগিয়ে দিচ্ছেন, নিজেদের কেরিয়ার এবং সমাজের টিপ্পনীর পরোয়া না করে, তাঁদের মনের জোর খুব, মানতেই হবে। ফের মনে পড়ছে ‘ক’-এর কথা। এক জন এমবিএ টপারের অফিস ম্যানেজমেন্টে মন নেই! উলটে সে পাক্কা গৃহিণীর মতো সংসার সামলায়। নিপুণ রাঁধুনির মতো নানাবিধ পদ রান্না করে স্ত্রী এবং শাশুড়িকে খাইয়ে, অফিসে পাঠিয়ে, তবে ফুরসত জোটে তার। এ হেন কাণ্ডকারখানা দেখলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা অবশ্যই বলতেন, স্ত্রৈণ কোথাকার! বা, ভেড়ুয়া! কিন্তু স্বামী-স্ত্রী যখন সমান শিক্ষিত এবং বহু ক্ষেত্রে সমান দক্ষও, তখন সমাজের এই সুস্থ পরিবর্তনই তো সভ্যতার ইঙ্গিত।

লাখ টাকার প্রশ্ন: চাকুরিরতা মেয়েরা কতটা সহজে স্বামীর গৃহবাসী পরিচিতি মেনে নিতে পারছে? কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে উঁচু পোস্টে থাকা ইলিনাদি-র কথা মনে পড়ছে। বড়সড় প্রোমোশনের পর তিনি দিল্লিতে বদলি হন এবং তাঁর ব্যাংকার-স্বামী রথীজিৎদা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছে যাওয়া ছেলেমেয়েকে নতুন স্কুলে স্থানান্তর করা সমীচীন মনে হয়নি কারও। দু’জন টিনএজ সন্তানকে বাড়িতে রেখে প্রাইভেট ব্যাংকের চাকরিতে মনোনিবেশ করা সমস্যা হবে ভেবে, পুরোপুরি গৃহস্থ হন রথীজিৎদা। মায়ের এই হঠাৎ দূরে চলে যাওয়ায় বাচ্চারা কোনও ভাবে অবসাদগ্রস্ত না হয়ে পড়ে, সে দিকে সব সময় নজর থাকত ওঁর। ইলিনাদি সংসারের যে সেট-আপ রেখে গিয়েছিলেন, তা অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ইউটিউব থেকে রান্না শিখে নানা পদ তৈরি করে খাওয়াতেন ছেলেমেয়েদের। ওদের পড়াশোনা দেখতেন, সময়ে সময়ে আউটিংয়ে নিয়ে যেতেন। কলকাতার বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে সেই খবর ক্বচিৎ ইলিনাদির কান অবধি পৌঁছত। স্ত্রীকে ব্যতিব্যস্ত করতে মোটেই চাইতেন না রথীদা। বলতেন, ইলিনা এগিয়ে যাক, ওর চাকরিতে সুযোগ ও সম্মান বেশি।

কিন্তু ইলিনাদির সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, স্বামীর হাউস-হাজব্যান্ড পরিচয়ে মোটে খুশি নন। এমনকী মেয়ে তুলিকাও নাকি ‘বাপি’র হোমমেকার স্টেটাসে বেশ আপসেট! কারণ? পুরুষকে পুরুষের কাজেই মানায়। প্রশ্ন জাগল, চাকরি করাটা ভারতীয় রীতি অনুযায়ী মেয়েদের কাজ ছিল কি? কিংবা পরিবার-পরিজন ফেলে মেয়েদের দূরে পোস্টিং নেওয়াটাও কি ‘নারীসুলভ’ ছিল? আমরা ঠিক কী চাই, আমাদের কাছে পরিষ্কার তো?

বোধহয় নয়। ভারতীয় নারীমনে উভয়সংকট যেন কাটতেই চায় না। স্বামী যখন স্ত্রী-সন্তান-সংসারের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ, আমরা অখুশি। আবার স্বামী যদি অফিস-অন্ত-প্রাণ হয়, তাতেও চিন্তায় ভারাক্রান্ত। সমাজতাত্ত্বিক কৌশাম্বী চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘আজকের নারীও অনেক ক্ষেত্রে প্রবল ভাবে সমাজ-নির্দিষ্ট করে দেওয়া বৃত্তেই আটকে থাকতে চান। অর্থাৎ, গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ তাঁর, আর বাইরের যা-কিছু দায়দায়িত্ব সবই পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট। আজও যদি এই জেন্ডার স্টিরিয়োটাইপের উপরে উঠতে না পারি, কবে আর পারব?’ এর জন্য দায়ী ছেলে ও মেয়ে বড় করার ক্ষেত্রে ফারাক, ভারতীয় সমাজে প্রোথিত লিঙ্গবৈষম্য এবং মান্ধাতা আমলের ধ্যানধারণা বদলে নতুন ভাবনায় উজ্জীবিত হতে আমাদের প্রবল অনীহা। একটা-আধটা সিনেমা তা বদলে দিতে পারবে না, কিন্তু বদলটা শুরু করতে হয়তো পারবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE