Advertisement
E-Paper

অবহেলায় পড়ে আছে বাঁকুড়ার বহু প্রত্ন নিদর্শন

বিষ্ণুপুরের অনেকগুলি মন্দির ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে নেই এবং সেগুলিও ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। মন্দিরের মতো অনাদরে পড়ে থাকা বীরস্তম্ভ ও মূর্তিগুলিও ক্ষয় পেতে পেতে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। লিখছেন সৌমেন রক্ষিত প্রাচীনকালে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া অঞ্চলে লালিত হয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তার নিদর্শন এখনও জেলা দু’টির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে। বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত দক্ষিণ বাঁকুড়ায় অনাদরে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে এমনই নানা মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০৪:৫৫

প্রাচীনকালে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া অঞ্চলে লালিত হয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তার নিদর্শন এখনও জেলা দু’টির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে। বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত দক্ষিণ বাঁকুড়ায় অনাদরে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে এমনই নানা মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

কংসাবতী, কুমারী, শিলাবতী, তারাফেনি, ভৈরব, বাঁকি নদী অববাহিকায় প্রত্নবস্তুর প্রাপ্তি অনেক। বেশ কিছু বিভিন্ন সংগ্রহশালা ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত রয়েছে। রাইপুর, পরকুল, বড্ডি, মণ্ডলকুলি, সাতপাট্টা প্রভৃতি এলাকা থেকে পাওয়া গিয়েছে বহু প্রত্নআয়ুধ, যেগুলি প্রাচীন সভ্যতার প্রমাণ দেয়। গড় রাইপুরের কাছে, কংসাবতী অববাহিকায় আবিষ্কৃত হয়েছে এক যুবকের চোয়ালের জীবাশ্ম। অনেকে মনে করেন, এটিই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ‘ফসিল’। বোঝা যায়, কংসাবতী অববাহিকার জনবসতি গড়ে উঠেছিল কমপক্ষে দশ হাজার বছর আগে। প্রত্নতাত্ত্বিক ভিডি কৃষ্ণস্বামীর নেতৃত্বে কাঁসাই-কুমারী অববাহিকায় ক্ষেত্রসমীক্ষা হয়েছে এবং সেখানে প্রত্নপ্রস্তর যুগ-সহ পরবর্তী সময়ের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।

শুশুনিয়াকে কেন্দ্র করেও নব্যপ্রস্তর যুগের বহু আয়ুধ পাওয়া যায়। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালায় এখানকার অনেক প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত আছে। তবে জেলায় সব থেকে বেশি উদ্ধার হয়েছে হাত-কুঠার। সিমলাপালের জড়িষ্যা গ্রামে আবিষ্কৃত চার ফুট ব্যাসের পাঁচটি পোড়ামাটির কূপ প্রাচীন সভ্যতার ইঙ্গিতবাহী। তালড্যাংরার হাড়মাসড়ায় পাওয়া প্রত্নচিহ্ন অনুযায়ী, ওই এলাকায় লোহা গলানোর বিশেষ ব্যবস্থা ছিল।

তালড্যাংরা থানার অন্তর্গত হাড়মাসড়া দক্ষিণ বাঁকুড়ার একটি অন্যতম প্রধান জৈনক্ষেত্র। মূল মন্দিরটি বর্তমানে অবলুপ্ত হলেও সংস্কৃত একটি জৈন দেউল বিদ্যমান। মন্দিরের পশ্চিমে সানবাঁধা নামক পুকুরের পাড়ে একটি পার্শ্বনাথের মূর্তি পড়ে রয়েছে। মূর্তিটি সপ্তনাগফনা সমন্বিত প্রায় ছ’ফুট উঁচু। খোলা আকাশের নীচে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকার কারণে মূর্তিটিতে ক্ষয় ধরেছে।

ইঁদপুরের ভেদুয়াশোলে ধানি জমির মাঝে একটি প্রস্তরনির্মিত ভগ্ন দেউলের ভেতরে দেখা মেলে, এক বিষ্ণুমূর্তির। আজানুলম্বিত মালা, মস্তকে কিরীট, কর্ণে কুণ্ডল, দক্ষিণে শ্রীদেবী, বামে সরস্বতী। এ রূপ বিষ্ণুমূর্তি প্রায় বিরল। এলাকাটি সাপ-খোপের আড্ডা। মূর্তিটি পুজোও পায় না বর্তমানে। আটবাইচণ্ডীর মূর্তি (যা আসলে তান্ত্রিক দেবী চামুণ্ডা বা দশভূজা দেবীচণ্ডীর মূর্তি) যে ভাবে গাছের তলায় পড়ে রয়েছে, দেখলে বিস্মিত হতে হয়। অথচ, বাঁকুড়ায় তন্ত্রসাধনার ইতিহাসে এই চণ্ডীর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

মুকুটমণিপুরের কাছে পরেশনাথে খোলা আকাশের নীচে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে রয়েছে প্রাচীন শিবলিঙ্গ ও প্রত্নমূর্তি। জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের নাম থেকে যে পরেশনাথ নাম এসেছে, তা অনেকে অনুমান করেন। প্রমাণও পাওয়া যায়, এক সময়ে এটি জৈনক্ষেত্র ছিল। এই পরিমণ্ডলে সারেংগড় ও অম্বিকানগরও প্রত্ন নিদর্শনে পরিপূর্ণ।

সিমলাপাল এলাকাতেও এ রূপ নানা প্রত্নমূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। জড়িষ্যায় একটি অচিহ্নিত মূর্তি গাছের তলায় বিদ্যমান। রামনগর, গোতড়া, লায়েকপাড়া প্রভৃতি এলাকাতেও এ জাতীয় নিদর্শন সহজে চোখে পড়ে। তবে সিমলাপাল রাজবাড়ির মন্দিরগাত্রে মহাবীরের মূর্তি-সহ বেশ কয়েকটি জৈন মূর্তি লক্ষ্য করা যায়। বাঁকুড়া শহরের এক্তেশ্বর মন্দিরের আশপাশে অনেকগুলি ভগ্ন মূর্তি খোলা আকাশের নীচে পড়ে আছে অবহেলায়। লক্ষ্মীসাগরে ফাঁকা মাঠে পড়ে আছে একটি প্রত্নমূর্তি, যেটি ক্ষয় পেতে পেতে এমন অবস্থা যে মূল কাঠামোর সঙ্গে মূর্তির অবয়ব প্রায় মিশে গিয়েছে।

এই সব প্রাচীন মূর্তি বা নিদর্শন সংরক্ষণে ব্যবস্থা যে নেওয়া হয়নি, এমন নয়। তবে কোনও জায়গায় গ্রামবাসীর উদ্যোগে মূর্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও তা সুরক্ষিত থাকেনি। ছাতনা থানার দেউলভিড়ায় লোকেশ্বর বিষ্ণুর অক্ষত মূর্তি ছিল, সঙ্গে ছিল বিখ্যাত ও বিরল নটরাজ এবং কুবেরের মূর্তি। দুর্ভাগ্যের বিষয় সব ক’টিই চুরি হয়ে যায়, বর্তমানে সেখানে মূর্তি তিনটির ‘রেপ্লিকা’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

প্রাচীন দেউল ও মন্দিরগুলিও সে ভাবে সুরক্ষিত নয়। ভেদুয়াশোলের পাথরের দেউলটি বর্তমানে ক্ষয় পেতে পেতে সাত ফুট দৈর্ঘ্যে এসে পৌঁছেছে। আবার তালড্যাংরার জৈন দেউলটিও ভগ্নপ্রায়। সোনাতপলের দেউলটিরও সংস্কারের অভাবে চূড়ায় গাছ গজিয়েছে। এমন বহু টেরাকোটার মন্দিরও প্রাকৃতিক কারণে ক্ষয় পেয়ে চলেছে, কিন্তু সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে কোনও পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। বিষ্ণুপুরের অনেকগুলি মন্দির ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে নেই এবং সেগুলিও ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। মন্দিরের মতো অনাদরে পড়ে থাকা বীরস্তম্ভ ও মূর্তিগুলিও ক্ষয় পেতে পেতে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে।

অথচ, শুধু কোনও একটি অঞ্চল নয়, জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রত্নবস্তু ও মূর্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বাস্তবে সেগুলির প্রতি নজর সে ভাবে দেওয়া হয় না। প্রশাসনও উদাসীন। এগুলি ঠিক ভাবে সংরক্ষিত করা হলে, এ সব নিয়ে চর্চা হলে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বহু অজানা ইতিহাস উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ইতিহাস জানা গেলে জাতির প্রাচীন রূপটিও ভাস্বর হবে।

লেখক সিমলাপাল মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক

Bankura Sculpture Negligence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy