Advertisement
০৯ মে ২০২৪

বিগ্রহ কোথায়, নানা জনশ্রুতি গিলাকাঁটিয়া মন্দিরে

জঙ্গলমহলের অশান্ত রাজনৈতিক পর্বের সাক্ষী একটি মন্দির। সেটি ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সময়ে নানা জনশ্রুতি। জড়িয়ে রয়েছেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বও। লিখলেন লক্ষীন্দর পালোইজঙ্গলমহলের অশান্ত রাজনৈতিক পর্বের সাক্ষী একটি মন্দির। সেটি ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সময়ে নানা জনশ্রুতি। জড়িয়ে রয়েছেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বও।

স্মারক: এই মন্দির ঘিরেই নানা জনশ্রুতি। নিজস্ব চিত্র

স্মারক: এই মন্দির ঘিরেই নানা জনশ্রুতি। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৯
Share: Save:

বিগ্রহ নেই মন্দিরে। কেন নেই? তার কোনও সদুত্তর মেলে না। শুধু নানা জনশ্রুতিতে অনুমান করতে হয়, মন্দির থেকে বিগ্রহ নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এই কারণগুলো কাজ করে থাকতে পারে। আবার এই মন্দির ঘিরে বেশ কিছু মানুষের আবেগ জড়িয়ে। যাঁরা বিশ্বাস করেন, মন্দিরে এক সময়ে বিগ্রহ ফিরে আসবে। মন্দিরটি কারা তৈরি করেছেন তা নিয়েও যথেষ্ট জটিলতা।

জঙ্গলমহলের গিলাকাঁটিয়া মন্দির বেশ পুরনো। হিসেব বলছে অন্তত ২৫০ বছরের। গোপীবল্লভপুরের এই মন্দিরটি আসলে এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যে এলাকা বারবার রাজনৈতিক কারণে অশান্ত হয়েছে। বদল হয়েছে রাজশক্তির। এবং রাজধর্মের। যার কারণে সম্ভবত এত জনশ্রুতি। এত আবেগ এবং আগ্রহ। কী হতে পারে মন্দির প্রতিষ্ঠা আর বিগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার কারণ? শুরু থেকে শুরু করা যাক।

মেদিনীপুরে ওড়িশার রাজাদের সঙ্গে রাজ্য আক্রমণকারী তুর্কিদের লড়াই লেগেই থাকত। তখন জঙ্গলমহলে ওড়িশার রাজা তৃতীয় অনঙ্গভীমের রাজত্বকাল। তাঁর সেনাপতি বিষ্ণুর সঙ্গে তুর্কিদের লড়াই শুরু হয়। এই লড়াই নরসিংহদেবের রাজত্বকাল অবধি চলে। ১২৩৬-১২৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তুর্ঘিল খাঁ সমগ্র জঙ্গলমহল অধিকার করেন। কিন্তু তিনি বেশি দিন জঙ্গলমহল দখলে রাখতে পারেননি। ১২৩৮-১২৬৪ সাল পর্যন্ত ওড়িশার রাজা ছিলেন গঙ্গ রাজবংশের নরসিংহ লাঙ্গুলিয়া। তাঁর কাছে পরাজিত হয়েই তুর্ঘিল লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতির দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। হ্যামিল্টনের লেখায় ও চৈতন্যচরিতামৃতে ওড়িশা রাজার রাজ্য বাঁচানোর এই সংগ্রামের উল্লেখ রয়েছে। এর পর আলাউদ্দিন হোসেন শাহ জঙ্গলমহল অধিকার করেন। তাঁর সেনাপতি ইসমাইল গাজি পুরী আক্রমণ করেছিলেন। তিনি পুরো বাংলা দখল করলেও জঙ্গলমহল-সহ ওড়িশা এবং বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর স্বাধীন ছিল।

আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, ১৫৭৫ সালে টোডরমল ও মুনিম খাঁ মেদিনীপুরে আসেন। সেই সময় মুঘল এবং আফগানদের মধ্যে যুদ্ধ চলে দাঁতনে ও নানকুরায়। যাকে অনেকে ‘মোগলমারীর যুদ্ধ’ বলেছেন। যদুনাথ সরকারও বলেছেন জঙ্গলমহলের এই যুদ্ধ আকবরকে বাংলাদেশে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী করে। ১৫৯২ সালে বাংলা ও ওড়িশা পুরোপুরি মুঘলদের অধীনে আসে। ১৭৪০-৪১ সালে আলিবর্দি জঙ্গলমহলের সুবাদার হন। ময়ূরভঞ্জের রাজা রঘুনাথ ভঞ্জ সুবর্ণরেখা নদীর রাজঘাটে আলিবর্দিকে বাধা দেন। কিন্তু তিনি পরাজিত হন। এই সময় বর্গি হামলা হয়। ১৭৫১ সালে আলিবর্দি ও মরাঠাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। পুরো ময়ূরভঞ্জ মরাঠাদের দখলে চলে যায়। জনশ্রুতি, সেই সময়েই এই মন্দির লুঠ হতে পারে। রাধমাধবকে সুবর্ণরেখায় ফেলে দেওয়া হতে পারে।

১৮৬৮ সালে কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জ রাজা হন। নয়াবসান ও নয়াগ্রাম পরগনাকে নতুন ভাবে সাজানো হয়। এই অঞ্চলে প্রচুর চৌকিদার, পাইকসেনা, দিগার, দলবেহারা, পাইক পদের সৃষ্টি হয়। মালেরা পাইক পদে নিযুক্ত হন। এই সময় কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জের রাজকর্মচারী ছিলেন রামনারায়ণ ষড়ংগী। যিনি ১১ বছরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জের অভিভাবক ছিলেন। ময়ূরভঞ্জ রাজ্যকে কোর্ট অফ ওয়াডর্স-এর হাত থেকে রক্ষা করেন। ১৮৮৩ সালে নয়বসানের দায়িত্ব পান সীতারাম মুখোপাধ্যায়। ১৮৯১ সালে রামনারায়ণ ষড়ংগী নয়াবসানের ম্যানেজার হন। ১৯০৭ সালে শ্রীরামচন্দ্র ভঞ্জ নয়াবসান কাছারি পরিদর্শন করতে এলে ভূমিজরা আন্দোলন করেন। অভয় মাইতি নামে এক কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। বিষয়টি ইংরেজরাও ভাল ভাবে নেয়নি। ইংরেজরা এলাকায় ধরপাকড় এবং অত্যাচার শুরু করে। জনশ্রুতি, এই সময়েই গিলাকাঁটিয়া মন্দির বিগ্রহহীন হয়। আবার ১৯৫০ সালে বন্যায় বিগ্রহ ভেসে যাওয়ার কথাও শোনা যায়।

তুর্কি আক্রমণের সময় থেকে ইংরেজ আমল পর্যন্ত নয়াবসান পরগনা ময়ূরভঞ্জ রাজার জমিদারির অন্তর্গত ছিল। তুর্কি, আফগান, পাঠান, মোঘল, মরাঠা, ইংরেজ প্রত্যেকের সঙ্গেই লড়াই চালিয়েছিলেন ময়ূরভঞ্জ রাজারা। চেষ্টা করেছিলেন নয়াবসান পরগনার জমিদারি ধরে রাখার। ৭৮ বছরে বৃদ্ধ মাল সম্প্রদায়ের হাড়িবন্ধু দাস বলেন, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষরা বাঁকুড়া থেকে তুর্কি আমলে এই অঞ্চলে আসেন। মালরা ছিলেন জাতিতে মল্লক্ষত্রিয়। সাহসী ও যোদ্ধা জাতি। তাই আমরা ওড়িশার রাজার পাহারাদার ও লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করতাম।’’ তিনি জানান, ওড়িশার রাজা পূর্ণচন্দ্র ভঞ্জ এবং প্রতাপচন্দ্র ভঞ্জ পর্যন্ত তাঁরা ‘নায়েক’ ও ‘দলবেহারার’ কাজ করেছেন। পাইকান জমিও ভোগ করেন। গাড়রাশোল মৌজা, ভোলামোহুলি মৌজা, রাঙিয়াম মৌজার বেশ কয়েক বিঘা জমি এখনও তাঁরা পাইকান হিসাবে চাষ করেন বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে রাঙিয়াম মৌজা এজমালি মৌজা। জনশ্রুতি, কোনও এক সময় নয়াবসান ও নয়াগ্রাম জমিদারি ঝাড়গ্রাম রাজ মল্লদেব অধিকার করতে এলে মালদের বংশধররা উদয় দাস ভুঁইয়ার নেতৃত্বে এঁরা নয়াবসান পরগনা থেকে তাদের হটিয়ে ওড়িশা রাজার অধীনে ফিরিয়ে আনেন। ১৪৮টি গ্রাম ও কিছু মোহর উপহার পেয়ে ছিলেন এবং ভুঁইয়া উপাধি লাভ করেছিলেন উদয় দাস। তখন থেকে মালরা ‘দাসভুঁইয়া’ পদবি লিখতে শুরু করেন। এর পর থেকে গিলাকাঁটিয়ায় তাঁরা জমিদারি শুরু করেন। শ্যামতরঙ্গ পরিখাটি খনন করে দুর্গাকারে বৃত্ত তৈরি করেন।

এই সময়ে বিষ্ণুর উপাসক ‘দাসভুঁইয়া’রা গিলাকাঁটিয়ার মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ইংরেজরা নয়াগ্রাম পরগনা আক্রমণ করলে ‘দাসভুঁইয়া’রা ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে পেরে উঠবেন না ভেবে ওড়িশায় পালিয়ে যান বলে বলা হয়। ‘দাসভুঁইয়া’দের দাবি, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এই গিলাকাঁটিয়ার মন্দিরটি নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি, উৎকলাচার্যের মদনমোহন ও মালদের মদনমোহন এক সঙ্গে গিলাকাঁটিয়ার মাঠে স্নান করানো হয়েছিল। তখনই দাসভুঁইয়াদের মদনমোহন উৎকলাচার্যরা পাল্টে নিয়ে যান। তার পর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আবার কেউ বলেন, শিবের ভক্ত বর্গিরা মদনমোহনকে সরিয়ে দিয়ে শিবলিঙ্গ স্থাপন করছিলেন। তাই কারও মতে এটি শিবমন্দির। আবার মালরা বিষ্ণুর উপাসক এবং ওড়িশার রাজার অধীনে নয়াসান পরগনা। তাই জগন্নাথের ভক্ত ভঞ্জ রাজারা শিবের মন্দির তৈরি করাবেন না। মন্দিরটি দেখলে বোঝা যায়, ওড়িশার শৈলীতে তৈরি। টুকরো টুকরো মাকড়া পাথর ছড়িয়ে। আর তাতে শিল্পকলার উৎকর্ষতা। যা নাকি বিগ্রহহীন গিলাকাঁটিয়া মন্দিরের চূড়ার গায়ে বসানো জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার ভগ্নমুর্তি।

অনেকে মালদের বিষ্ণুপুরের মল্লক্ষত্রিয় বীর হাম্বিরের বংশধর বলেন। হাম্বির বৈষ্ণব ধর্মালম্বী ছিলেন। তাই মালরা বিষ্ণু বা মদনমোহন রাধারানির মন্দিরই তৈরি করবেন। নয়াবসন পরগনার একমাত্র ‘দিগার’ ভোলা গ্রামের দ্বারিকানাথ সাহুর বংশধরের ৯২ বছরের কামিনীবালা সাহু বলেন এই মন্দিরে মদনমোহনের পুজো হতো। এক সময়ে মকরসংক্রান্তির আগের দিন নয়াবসান পরগনায় পাড়ুয়ার ঝরনাতে ‘বারনি’ হতো। গোঁসাইরা পালকি করে স্নান করতে আসতেন। গিলাকাঁটিয়ার মাঠে তখন মদনমোহনের মেলা বসত।

মন্দিরটি নিয়ে মহীপালের মাল সম্প্রদায় আজও স্বপ্ন দেখেন। মালেদের মদনমোহন একদিন গিলাকাঁটিয়া মন্দিরে চলে আসবেন।

লেখক অধ্যাপক ও লোকসংস্কৃতির গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Temple History Hearsay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE