নরেন্দ্র মোদী বক্তৃতায় বলিলেন, গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হইতে হইবে। যাহার ক্ষমতা অধিক, তাহার দায়িত্বও অধিক— প্রধানমন্ত্রী এই সর্ববিদিত সত্য স্মরণ করাইয়া দেওয়ায় তত্ত্বের ইতরবিশেষ হইবে না, কিন্তু নিহিত বার্তাটি বুঝিতে অসুবিধা হয় না: সরকারের সমালোচনা করিবার সময় গণমাধ্যমকে অধিক সংযত ও সতর্ক হইতে হইবে। গণমাধ্যম কেন, সকল ব্যক্তি ও সকল প্রতিষ্ঠানকেই স্বাধীনতার সহিত সংযম মিশাইয়া চলিতে হয়, প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা রহিয়াছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিতে হইবে: গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নহে, মাধ্যমটির পাঠকের, শ্রোতার, দর্শকের প্রতি। সেই ভোক্তা গণমাধ্যমের নিকট প্রত্যাশা করেন সংবাদ ও তাহার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। তিনি প্রত্যাশা করেন তাঁহার অভাব-অভিযোগগুলিকে তুলিয়া ধরা হইবে, সমস্যা ও দুর্নীতির জন্য দায়ী মানুষদের প্রতি শাণিত শর নিক্ষেপ করা হইবে। একটি গণতন্ত্রে কী কী যথাযথ ভাবে চলিতেছে না ও তাহার জন্য কাহারা দায়ী, তাহা চিহ্নিত করা গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। তাই গণমাধ্যমের মূল কাজ অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন, দোষপ্রদর্শক অঙ্গুলিনির্দেশ, বিশেষত যাঁহারা ক্ষমতায় আছেন তাঁহাদের প্রতি। নির্বাচিত সরকারের প্রতি বিশেষ বিদ্বেষ লইয়া গণমাধ্যম কাজ করিবে না ঠিকই, কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ নজর লইয়া তাহাকে প্রতিনিয়ত জরিপ করিবে, কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা তাহার হাতে। সেই অতন্দ্র ও আপসহীন বিচার-দৃষ্টির জন্যই গণমাধ্যম গণতন্ত্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’, যাহা প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। গণমাধ্যম যদি নির্দিষ্ট দল বা মতবাদের প্রতি অনুগত হইয়া পড়ে, তবে সেই দায়বদ্ধতা হইবে বদ্ধতারই সমার্থক। নির্বাচিত সরকার যদি গণমাধ্যমের প্রবল কশাঘাত সহিতে প্রস্তুত না থাকে, তাহার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে লড়িবার পরিণতমনস্কতাই নাই।
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ হইতে যখন গণমাধ্যমের দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া হয়, তাহা বাক্স্বাধীনতার বিপদের আভাস বহিয়া আনে। গভীর সন্দেহ হয়, ইহা বস্তুত সতর্কীকরণ, হুমকি: যদি নিরন্তর সরকারের সমালোচনা করিতে থাকো, সমুচিত প্রতিদান পাইবে। বিশেষত এমন এক আবহাওয়ায় যেখানে কার্টুনশিল্পীকে গ্রেফতার করা হইতেছে জেলা পুলিশ কমিশনার, কালেক্টর ও মুখ্যমন্ত্রীকে নিরাবরণ অবস্থায় আঁকিবার জন্য, যাঁহাদের সম্মুখে নিজেদের গাত্রে অগ্নিসংযোগ করিয়া আত্মহত্যা করিতেছে একটি গোটা পরিবার। বহু লেখক সাংবাদিক মানবাধিকার-কর্মীকে নিগ্রহ বা হত্যা করা হইতেছে। গণমাধ্যমের কোনও কোনও অংশে প্রতিনিয়ত হুংকার শোনা যাইতেছে: বিরুদ্ধ-মতাবলম্বীকে বলিবার সুযোগই দেওয়া হইবে না, কারণ তাহারা প্রশ্নাতীত ভাবে দেশদ্রোহী। জাতীয়তাবাদের আবেগকে অজুহাত হিসাবে দর্শাইয়া টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ করা হইতেছে বা আন্তর্জালের সংবাদ-পরিবেশককে মামলায় ফাঁসানো হইতেছে। ছাত্র সংগঠন বিদ্যায়তনে নির্ধারিত আলোচনাচক্র বাতিল করিতে লাফাইয়া পড়িতেছে। সর্ব স্তরে অপছন্দের মতামতকে গলা টিপিয়া মারা দেশভক্তির ব্যায়াম বলিয়া প্রশংসা অর্জন করিতেছে। ইহাই বরং গণমাধ্যমের লাগাতার প্রতিবাদ করিবার সময়। বলিবার সময়, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয় ব্যতীত দেশ জুড়িয়া অসুস্থ অসহিষ্ণু হিংস্র পরিবেশ জয়ী হইত না। যদিও এই ক্ষেত্রে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষ দিয়া লাভ নাই। যে যায় লঙ্কায় সে-ই রাবণ হয়, কেবল ন্যূন রাবণ ও অধিক রাবণ, ইহাই পার্থক্য। এবং, লঙ্কা কেবল কেন্দ্রে নাই, রাজ্যেও বিলক্ষণ থাকিতে পারে, এমনকী এই রাজ্যেও— অম্বিকেশ মহাপাত্র স্মরণীয়। দেশের সকল ক্ষমতাকর্তা ও কর্ত্রী গণমাধ্যমের দায় বিচার না করিয়া নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক পাঠ লইলেই গণতন্ত্রের মঙ্গল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy