Advertisement
E-Paper

ভয় দেখিয়ে আর লাভ নেই

ভ য় কত রকমেরই হয়। তার ওপর এখন তো দেশে ও দুনিয়ায় ভয়ের দাপট অতিমাত্রায় প্রবল।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০

ভ য় কত রকমেরই হয়। তার ওপর এখন তো দেশে ও দুনিয়ায় ভয়ের দাপট অতিমাত্রায় প্রবল। এরই মধ্যে ইদানীং এক নতুন ভয়ের কথা শুনছি। মেয়েদের কাজের সুযোগ হারানোর ভয়। যে ভাবে কিছু মেয়ে তাঁদের অতীত অপমানের কথা ফাঁস করছেন, আর তার পরিণামে সমাজের নানা পরিসরের উঁচু পদের এবং উঁচু দরের নানান পুরুষ যে ভাবে বিপাকে পড়ছেন, তার প্রতিক্রিয়ায় যদি এর পরে কাজ দেওয়ার মালিকরা মেয়েদের চাকরি দিতে না চান? ভাবেন, কী দরকার বাবা ও-সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে গিয়ে, তার চেয়ে পুরুষকর্মী নেওয়াই ভাল? এমন ভাবনা যত বাড়বে, মেয়েদের চাকরির সুযোগ তত কমবে না তো? ভয়ের কথা বইকি।

এই ভয় চারিয়ে দেওয়ার এক প্রকল্প অতঃপর দানা বেঁধে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে মেয়েরা অনেক অন্যায় আর অনাচারের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে অপরাধের বৃত্তান্তগুলিকে জনসমক্ষে আনতে পেরেছেন, তাঁদের দৃষ্টান্তে সাহস সংগ্রহ করে যে মেয়েরা নিজের না-বলা কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের ডেকে বলা হতেই পারে, ‘‘কী করছ মা-জননীরা? নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারছ? এর পরে কে তোমাদের চাকরি দেবে বলো দেখি? দু’দিন এ-সব নিয়ে লোকে নাচানাচি করবে, তার পর সবাই সব ভুলে যাবে, মাঝখান থেকে তোমরা, মেয়েরাই বিপদে পড়বে। এমন বোকামি করতে নেই, এত দিন যেমন গোপন কথাটি গোপনে রেখেছিলে, তেমনই রাখো, রেখে চলো।’’

এ হেন সুপরামর্শ শুনে মেয়েরা যদি ভয় পেয়ে যান? ভয় পেয়ে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন? চাকরির বাজার ভাল নয়, বিশেষ করে যে ধরনের কাজ করতে গিয়ে মেয়েদের লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে, সেই সব কাজের দুনিয়ায় অনিশ্চয়তা ইদানীং অত্যন্ত বেড়েছে, প্রতিযোগিতাও তীব্র থেকে তীব্রতর। ফলে কাজ হারানোর এবং কাজ না পাওয়ার ভয়— ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে— সকলেরই নিত্যসঙ্গী। এই ভয়ের তাড়নাতেই কর্মীরা— ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে— বহু অন্যায়, বহু অসম্মান মেনে নিতে বাধ্য হন, মেনে নিয়ে কাজ করে যান। সুতরাং মুখ খুললে চাকরি যাবে— এই আতঙ্ক বাজারে চালাতে পারলে মুখ বন্ধ করার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই বাড়ে। মেয়েদের সমস্যার বাড়তি মাত্রাটি সুপরিচিত, তাঁদের বিশেষ ধরনের নানা অস্বস্তি, অপমান, উপদ্রব মেনে নিতে হয়, যা আসলে ক্ষমতার অত্যাচার, ক্ষমতাসীন পুরুষের অত্যাচার। এখন ঠিক সেই ধরনের অন্যায়ের কাহিনিগুলিই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ফলে হুঁশিয়ারি ভেসে আসছে, ‘চুপ কর বোকা মেয়ে, বলিস না আর।’ শুনলে গা ছমছম করতেই পারে।

ভরসা একটাই। মেয়েরা অনেকেই নিজের কথা স্পষ্ট করে বলার যে সাহস নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন, নিজের মর্যাদার দাম তাঁরা যে ভাবে বুঝে নিতে শিখেছেন, তাতে ভয় দেখিয়ে তাঁদের খুব একটা বাগে আনা যাবে বলে মনে হয় না। ‘এত দিন কোনও অভিযোগ করেননি, এখন কেন করছেন’— এই বস্তাপচা কুপ্রশ্ন তুলে যাঁরা খেলাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ এবং করুণ চেষ্টা করছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না বা চাইছেন না যে, আজকের শিরদাঁড়া-সোজা-রাখা মেয়েদের কাছে এ-প্রশ্নের খুব সহজ এবং সরল জবাব আছে। তাঁরা চোখে চোখ রেখে শুনিয়ে দিতেই পারেন, ‘কখন অভিযোগ করব, সেটা আমরা ঠিক করব। এত দিন করিনি, বেশ করেছি। এখন করব, বেশ করব।’ ঠিক তেমনই, যাঁরা ‘সম্মতি’র দোহাই পেড়ে বলছেন, ‘তখন তো তুমি রাজি হয়েছিলে, এখন কেন নালিশ করছ’, মেয়েরা তাঁদের মুখের উপর বলে দিতে পারেন: ক্ষমতার দাপটে আদায় করা সম্মতির কোনও মূল্যই থাকতে পারে না। এবং আর এক পা এগিয়ে গিয়ে ঘোষণা করতে পারেন নৈতিকতার সেই মৌলিক সূত্র, যা বৌদ্ধ দর্শনের এক মহামূল্যবান শিক্ষা, যে শিক্ষার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অমর্ত্য সেন তাঁর নীতি ও ন্যায্যতা গ্রন্থে: ক্ষমতার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকে দায়িত্ব, ক্ষমতার সুব্যবহার করার (সুতরাং অপব্যবহার না করার) দায়িত্ব। ক্ষমতার সুযোগে যিনি দুর্বলের সম্মতি আদায় করেন তিনি অন্যায় করেন, ওই সম্মতি কোনও অবস্থাতেই তাঁর আচরণের সাফাই হতে পারে না। এটা আইনের প্রশ্ন নয়, নীতির প্রশ্ন। মেয়েরা আগে এই তর্ক করতেন না, করার কথা ভাবতেন না, এখন অনেকেই ভাবছেন, তর্ক তুলছেন, আরও তুলবেন।

আসলে, সময়টা বদলে গিয়েছে। সময় কখন বদলায়, কী ভাবে বদলায়, তার কোনও অঙ্ক হয় না, কিন্তু যখন বদলায় তখন তাকে ভয় দেখিয়ে থামানো যায় না। তখন তার দাবি স্বীকার করে নিতে হয়, তার সামনে নতজানু হয়ে আত্মশুদ্ধির অঙ্গীকার করতে হয়। এটা পিতৃতন্ত্রের আত্মশুদ্ধির সময়। তাকে বুঝতে হবে, তার রাজ্যপাট এত দিন যে ভাবে চলেছে, এখন আর সে ভাবে চলবে না। এত দিন পুরুষ ঘরের বাইরে কাজ করতে আসা মেয়েদের যে চোখে দেখেছে, সেই চোখ এখন বদলে ফেলতে হবে। মেয়েদের সঙ্গে, মেয়েদের প্রতি এমন অনেক আচরণের স্বাধীনতা এত কাল পুরুষ ভোগ করে এসেছে, যা এখন বাতিল হয়ে গিয়েছে। এই সত্যটাকে মেনে নিতে অনেক পুরুষেরই অসুবিধে হবে, কষ্ট হবে, অনেক অভ্যস্ত রসিকতার জন্য তাঁদের মন ছটফট করবে, অনেক চিরাচরিত ব্যঙ্গের বাণী তাঁদের অন্তরে গুমরে গুমরে উঠবে, অনেক প্রচলিত সুযোগ নেওয়ার জন্য তাঁদের সর্বাঙ্গ নিশপিশ করবে, কিন্তু কিছু করার নেই, বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভ্যেস ছাড়তে হয়— লেজের মতোই। নিজেকে বদলানোই এখন পুরুষের দায়।

দায়িত্ব মেয়েদেরও। দায় নয়, দায়িত্ব। পুরুষের চোখে চোখ রেখে তাকে এই স্পষ্ট কথাটা স্পষ্ট করে বলার দায়িত্ব যে— সহকর্মী বা সহযাত্রী বা সহনাগরিক মেয়েকে ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীগত সম্পত্তি এবং উপভোগের সামগ্রী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে শিখুন। আর হ্যাঁ, যে পুরুষ বা পুরুষতন্ত্র চুপ করে থাকতে বলে, মুখ খুললে চাকরি যাওয়ার, চাকরি না-পাওয়ার ভয় দেখায়, তাকে মুখের উপর এই জবাব দেওয়ার দায়িত্ব যে— মেয়েদের বয়কট করে পৃথিবীটাকে চালানোর চেষ্টা করেই দেখুন না, ফল কী হয়।

একটি প্রতিপ্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে কি কাজের পরিসরে পুরুষ এবং নারীর মধ্যে লড়াইয়ের সম্পর্কই অমোঘ, অনিবার্য? কেবল অবিশ্বাস, সন্দেহ, অভিযোগ, শাস্তি আর ভয়ের ধারাই সেখানে সচল থাকবে? উত্তর স্পষ্ট। পিতৃতন্ত্র তেমন পরিবেশই জারি রাখতে চায়, কারণ তা হলেই তার শাসন অক্ষুণ্ণ থাকে। শাসন তো কেবল নারীর উপরে নয়, পুরুষের উপরেও— ভুলে গেলে চলবে না, ব্যক্তি-পুরুষও পুরুষতন্ত্রের বশীভূত, তার চিন্তা এবং আচরণও সেই তন্ত্রের নির্দেশেই চালিত হয়। পুরুষ বনাম নারী— এই বিভাজন পিতৃতন্ত্রকে শক্তি জোগায়, কায়েম থাকার শক্তি। এবং মনে রাখতে হবে, বাজার অর্থনীতি যে বৃহৎ (এবং ক্রমশ বৃহত্তর) পুঁজির নিয়ন্ত্রণে, এই বিভাজন তার পক্ষেও অতি উপকারী। বিশেষ করে মেয়েরা যখন প্রবল ভাবে কাজের দুনিয়ায় শরিক হচ্ছে, তখন এই বিভাজন জারি রাখতে পারলে শ্রমিকের সংহতি আরও দুর্বল, আরও বিপন্ন হয়, পুঁজির তাতে পরম আহ্লাদ।

আর সেই কারণেই ব্যক্তি-পুরুষের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন এত বেশি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বহু পুরুষ, হয়তো অধিকাংশ পুরুষই মেয়েদের কাছে অন্যায় সুযোগ নিতে চান না, আর কোনও কারণে না হোক স্বাভাবিক আত্মমর্যাদার কারণেই চান না। কিন্তু শুধু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতার গভীরেও নিহিত থাকে বহুযুগলালিত পিতৃতন্ত্রের ধারণা, যা অনেক পুরুষকেই— এমনিতে ভদ্র সভ্য পুরুষকেও— মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখতে দেয় না। পুরুষের চেতনায় ও অবচেতনে নিহিত পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানসিক লড়াই কত কঠিন, সে কথা প্রতিনিয়ত অনুভব করি— এই সত্য অকপটে কবুল করতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই।

কিন্তু লড়াইটা নিরন্তর জারি রাখা চাই। তবেই ওই বিভাজনের ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করা যাবে। সেটা সহজ নয়, কিন্তু সম্ভবপর। সম্ভাব্যও। তার নানা লক্ষণ চার পাশে। চার পাশে প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি নতুন মেয়েদের। নতুন পুরুষদেরও। ভয় দেখিয়ে তাঁদের পোষ মানাবেন? বেস্ট অব লাক।

MeToo Controversy Patriarch Society
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy