Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

পথের বদলে বিপথ

লাঠি বা নিষেধাজ্ঞা শুধু অবিশ্বাস বাড়ায়। রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস বাড়াইয়া জঙ্গিদলে যোগদান আটকাইতে হইলে, কিছু বিশ্বাস উদ্রেককারী কাজ রাষ্ট্রকে করিতে হইবে।

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১৩
Share: Save:

দুই হাজার আঠারো সালে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ নিজের জন্য একটি কঠিন লক্ষ্য স্থির করিয়াছে। গত বৎসর তাহার কাজ ছিল, উপত্যকার উগ্রপন্থীদের উচ্চ নেতৃত্বকে ঘায়েল করা। তাহাতে অনেকাংশে সাফল্য পাওয়া গিয়াছে। এ-বৎসরের কাজ: উপত্যকার তরুণ সম্প্রদায়কে উগ্রবাদীদের দলে নাম লিখানো হইতে প্রতিহত করা। তাহাদের জঙ্গি প্রভাব হইতে মুক্ত করা। সঙ্গে-সঙ্গে, জঙ্গিপনা ছাড়িয়া যাহারা আবার স্বাভাবিক নাগরিক জীবনে ফিরিতে চায়, তাহাদের সহায়তা করা। রাজ্য পুলিশের দাবি, গত বৎসরে নাকি অন্তত ৭০ জনকে ‘ফিরানো’ গিয়াছে। আরও চেষ্টা করিলে সংখ্যাটি আরও অনেক বাড়িবে, ইহাই আশা। চলতি বৎসরের পয়লা জানুয়ারি ডিজিপি অতি প্রসন্নতার সহিত জানাইয়াছিলেন, প্রথম দিনেই সুখবর, তিন জন কাশ্মীরি যুবা জঙ্গি খপ্পর হইতে ‘পলাইয়া’ আসিয়াছেন। ঠিকই, এই ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা কতটা গুরুত্ব সহকারে লওয়া যায়, তাহা একটি প্রশ্ন বটে। পুলিশবাহিনীর মধ্যেই গভীর সন্দেহ লুকাইয়া যে, যত সংখ্যক মানুষ উগ্রপন্থা ছাড়িয়া দিতেছেন, তাহার অপেক্ষা বেশি সংখ্যায় নূতন ‘রিক্রুট’ তৈরি হইতেছে। সুতরাং, জঙ্গির সংখ্যা যদি চ্যালেঞ্জ হয়, পুরাতনদের ফিরাইবার অপেক্ষা নূতন ‘রিক্রুট’ বন্ধ করিবার দিকেই বেশি মন দেওয়া দরকার। এই উদ্দেশ্য সামনে রাখিয়া ঘোষিত হইল সে রাজ্যের সিআইডি ও পুলিশের ইনটেলিজেন্স বিভাগের সিদ্ধান্ত— নিহত জঙ্গি সমাধি উপলক্ষে আজকাল উপত্যকায় যে রকম বিরাট জনসমাবেশ হইয়া থাকে, তাহার সুযোগ ব্যবহার করিয়া জঙ্গিবাহিনীর রিক্রুট চলিতে থাকে। এই ধারাটি বন্ধ করিতে হইবে, সমাধি-উৎসবগুলিতেই রাশ টানিতে হইবে। গত কয়েক বৎসরে ‘ফিউনেরাল’গুলির যে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তৈরি হইয়াছে, তাহা আটকাইতে হইবে।

এইখানেই প্রশ্ন। সন্দেহ নাই, এই ধরনের অনুষ্ঠানের জাঁকজমক বাড়িলে জঙ্গি কার্যক্রমের গৌরবায়নও দ্রুত হারে বাড়িবে। মানুষের কাছে নিহত জঙ্গি নেতারা নায়ক হিসাবে প্রতিভাত হইবেন, তাঁহাদের দৃষ্টান্ত অল্পবয়সিদের কাছে আরও আকর্ষক হইবে। কিন্তু পুলিশি হস্তক্ষেপে সমাধি অনুষ্ঠান বন্ধ করিলে কি মানুষের মন পালটানোর সম্ভাবনা বাড়িবে? সাধারণ বুদ্ধি কিন্তু বলে যে, মানুষ কোনও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করিতে চাহিলে ও পুলিশ সেই ইচ্ছায় বাধাদান করিলে মানুষের আগ্রহ কমিবার বদলে বরং বা়ড়িয়াই যায়। এই সামান্য কথাটি পুলিশ ও নেতারা বুঝিতে পারেন না বলিয়া, আফজল গুরুকে ফাঁসি দিবার পর তাঁহারা বিস্ময়াভিভূত হইয়া দেখেন, কেমন ভাবে আফজল গুরু ক্রমে রাষ্ট্রবিরোধিতা তথা ভারত-বিদ্বেষের বিরাট প্রতীক হইয়া উঠিয়াছেন। সেই প্রতীকের জোর এমনই যে তাঁহার ফাঁসির দিনটিতে জঙ্গি হানা কাশ্মীরে এখন বাৎসরিক প্রথা।

লাঠি বা নিষেধাজ্ঞা শুধু অবিশ্বাস বাড়ায়। রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস বাড়াইয়া জঙ্গিদলে যোগদান আটকাইতে হইলে, কিছু বিশ্বাস উদ্রেককারী কাজ রাষ্ট্রকে করিতে হইবে। রাষ্ট্র যে ভাল কিছু করিতে পারে, পুলিশ যে মানুষের মঙ্গল চাহিতে পারে, এই বিশ্বাসই যে জনগোষ্ঠীর মন হইতে উবিয়া গিয়াছে, তাহাদের অন্যত্র আস্থা অর্পণের টান বাড়িবেই। যে উপত্যকায় এতগুলি দশক ধরিয়া স্বাভাবিক জীবনযাপন নাই, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নাই, ব্যবসাবাণিজ্যের সুযোগ নাই, পরিবহণের সুবন্দোবস্ত নাই, কেবল জঙ্গি সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ তল্লাশি ও ধরপাকড় আছে, সেখানে আরও এক গোছা নূতন নিষেধাজ্ঞা দিয়া নাগরিক আস্থা অর্জনের আশা বাতুলতা। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এই ভাবনা হইতেই পুুলিশকে জঙ্গিদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালাইতে বারণ করিয়াছেন, ফলত বিজেপি নেতৃত্বের চক্ষুশূল হইয়াছেন। বিজেপি রাজনীতির বড় সমস্যা তো ইহাই— ধর তক্তা মার পেরেক ছাড়া কোনও গভীরতর স্ট্র্যাটেজি তাহার অভিধানে নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Government Millitants Rehabilitation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE