Advertisement
১১ মে ২০২৪

কেন মোবাইল দেবেন না?

মনে হতে পারে, এগুলো অবাস্তব নীতিবাক্য। তাই, এটুকু বলে রাখা ভাল, আমি প্রায় ৩৭ বছর এই চাকরিই করেছি। ক্লাস নেওয়াটা শতকরা ১০০ ভাগই শিক্ষকের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ব্যাপার।

দেবেশ রায়
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

স্কুলের ছেলেমেয়েদের স্কুলে বা ক্লাসে মোবাইল ফোন নিয়ে আসা নিয়ে এমন এক কথাবার্তা উঠেছে যে শিক্ষামন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, মোবাইল ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবতে হবে। আমাদের এক জন অভিভাবক না হলে চলে না। ক্লাসে মোবাইল নিয়ে এলে যদি শিক্ষকের পড়াশোনার অসুবিধে হয়, সেটা তো সেই শিক্ষকের সমস্যা। একটা ক্লাসে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা মোবাইল ব্যতীতই তাঁর ক্লাস নেওয়ার অসুবিধে করতে পারে। তখনও কি শিক্ষামন্ত্রীর অভিভাবকতা দরকার হবে?

সব ব্যাপারে যেমন, এই ব্যাপারেও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে নীতির কথা তোলা হয়েছে। মোবাইল আনলে ছেলেমেয়েরা ক্লাসের পড়ায় মন দেয় না। যে শিক্ষক তাঁর পড়ানোতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আঙুলের চাঞ্চল্য বন্ধ করতে পারেন না, তিনি বরং নিজেকে নিয়ে ভাবুন, কী করে সেটা করা যায়। মোবাইল আনা নিষিদ্ধ হোক, হেডমাস্টারমশায়ের কাছে জমা হোক, মোবাইলহীন আঙুল আপন মনে খেলা করে যাবে আপাত-বধিরতায়। শিক্ষককেই তাঁর পাঠ্যের কোনও বিকল্পকে অকেজো করে দিতে হবে। এটাই তাঁর পেশার চ্যালেঞ্জ। সব পেশারই চ্যালেঞ্জ থাকে। শিক্ষামন্ত্রী ক্লাসের অভিভাবক নন।

মনে হতে পারে, এগুলো অবাস্তব নীতিবাক্য। তাই, এটুকু বলে রাখা ভাল, আমি প্রায় ৩৭ বছর এই চাকরিই করেছি। ক্লাস নেওয়াটা শতকরা ১০০ ভাগই শিক্ষকের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ব্যাপার। ওখানে কোনও যন্ত্র বা শিক্ষামন্ত্রীকে ডেকে আনা যাবে না। কোনও চৌকিদারিও চলবে না। প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষকদের ক্লাস করেছি। এক বর্ণও না বুঝে, খাতায় স্লিপ লিখে লিখে নীরব আড্ডা মেরে গেছি। আবার, আর এক জন সমতুল্য শিক্ষক বোর্ড আর কথা দিয়ে এমন সুগম করে দিতেন দুর্গমতম দেহতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব, যে নিজেরা লজ্জা পেতাম— এটুকুও বুঝে নিতে পারিনি! কিন্তু কোনও আত্মজৈবনিক সাধারণীকরণের সুযোগ নেওয়ার জন্য আজ প্রসঙ্গটি আনিনি।

দিল্লির নানা নামকরা-আধানামকরা বেসরকারি স্কুলে দেখেছি ক্লাসে এই এখনকার স্মার্ট ফোনের নানা কৌশলের সুবাদে সেটা ক্লাসের একটা উপকরণ হয়ে উঠেছে, ব্ল্যাকবোর্ডের মতো। ফলে, যে সব কালানুক্রমিক তথ্য সংগ্রহ ক্লাসের প্রায় প্রধান কাজ, সেগুলো ছেলেমেয়েরা ক্লাসেই শিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী গ্রাফিক্স-সহ দেখছে। শিক্ষক-সহ ছাত্রছাত্রী সকলেরই চোখ মোবাইল পরদায়। এ বার শিক্ষক সেই সব তথ্যের ভেতরের সম্পর্কগুলি বললেন। সেটা হচ্ছে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, যা মোবাইলের ক্ষমতার বাইরে, কিন্তু মোবাইলটি না থাকলে ওই তত্ত্ব ছেলেমেয়েরা ধরতেই পারত না। এ বার শিক্ষক বললেন, ‘যা ব্যাখ্যা শুনলে, তা বুঝে এই তথ্যগুলো নতুন গ্রাফিক্স-এ সাজানোর চেষ্টা করো। যার যখন হবে আমার মেল-এ পাঠিয়ে দিয়ো।’

দেখেছি স্কুলের হোমটাস্কের তালিকাও। এমন টাস্ক দেওয়া হয়েছে যা কম্পিউটার খুঁজে বার করতে হবে। ছ’সাত বছরের এক বাচ্চা মেয়ে কী তৎপরতায় আমারই মোবাইল, আইপ্যাড ঘেঁটে সেই সব উত্তর বের করছে।

ওর নিজের একটা যন্ত্র নেই কেন? ওর পড়াশোনার জন্যই তো দরকার। বাচ্চার মা আমাকে বকলেন ও বোঝালেন যে, তা হলে সারা দিন গেম‌্স খেলবে। আমি হদ্দ বোকার মতো বললাম, আমাকে এক দিন গেমের পার্টনার করেছিল, আমি বুঝে উঠতে পারিনি, আর বেশ কঠিন ‘প্রবলেম’ ওরা ‘ট্যাকল’ করছে, গভীরতম মনোযোগে। আমরা তো চাই, আমাদের নাতিনাতনিরা মনঃসংযোগ আরও করুক। মন দিলে আবার শিখতে কত ক্ষণ। মোবাইল সেই মনঃস‌ংযোগ সম্ভব করে তুলেছে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে সাধারণ নীতি নির্ধারণের পদ্ধতি ভুল। ব্যক্তিগত সুবিধে-অসুবিধে দিয়ে সাধারণ নীতি বিচার করাও ভুল। না হলে অজস্র কাহিনি বলতে পারতাম, আমার আপাদমস্তক কম্পিউটার-মূর্খতা প্রতি দিন কী করে এই শিশু-কিশোরেরা অনায়াসে পার করে দেয়। আবার, ওরা যখন অসুবিধেয় পড়ে তখন আমার বইপত্র থেকে কী করে ঠিক উত্তরটা খুঁজে নিয়ে যায়।

স্কুলে বা ক্লাসে মোবাইল নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তাতে, আমার অনুমান, প্রধানত জড়িয়ে আছেন আমাদের সরকারি সাহায্যপুষ্ট স্কুলগুলি। সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এটা কোনও সমস্যা নয় ও এই সব স্কুলে মোবাইল শিক্ষা আবশ্যিক উপকরণ।

একটু ভয় নিয়েই লেখাটা লিখতে বাধ্য করলাম নিজেকে। ছেলেমেয়েদের মা-বাবাদের ও আমাদের এই ছেলেমেয়েরা যে সব স্কুলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় পড়ে সেই সব স্কুলের শিক্ষকশিক্ষিকাদের মনের ভূত তাড়ানো দরকার। ছেলেমেয়েদের সন্দেহ করে, তাদের চিন্তাভাবনা বুঝতে চেষ্টা না করে তাদের স্বাধীন প্রবণতাকে বাড়তে না দিয়ে তাদের জাঁতাকলে পেষণ মানে অভিভাবকতা নয়, শিক্ষকতাও নয়। বাইরের দুনিয়া আমাদের ঘরের দুয়োর ভেঙে দিয়েছে। সেই দুনিয়াকে ওদের কাছ থেকেই জানতে হবে। অন্ধ মধ্যবিত্ত-পরিবারসুলভ সাবধানতায় ও আশঙ্কায় ওদের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেবেন না, মোবাইল থেকে ওদের ‘রক্ষা’ করবেন না। মোবাইলে শুধু পর্ন-চ্যানেলই থাকে না। যখন মোবাইল কেউ জানত না তখন কুৎসিত সব উপায়ে আমাদের অপ্রতিরোধ্য যৌন শিক্ষাও হত। তার কিছু অবশেষ এখনও তো প্রতি রাতে টিভি-সংবাদে দেখা যায়।

আরও একটা অনুভববেদ্য সত্য সাহস করে বলতে চাই। যাকে বিদ্যাদান বলে, সেই শিক্ষক বা গুরুর কাছ থেকে বিদ্যাগ্রহণ, যা একমাত্র গুরুর হেপাজতেই আছে, গুরুই যার একমাত্র দাতা হতে পারেন— এই পেডাগজি একেবারে পালটে গেছে। এখন বিদ্যার উৎস সকলের জন্যই মুক্ত। শিক্ষক বলে কোনও বিশেষ কেউ সেই বিদ্যার ভাণ্ডারী নন। ছাত্রছাত্রী অনেক সময়েই বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব নিয়েই ক্লাসে বসে। শিক্ষক তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে কতকগুলি পদ্ধতির দিশা দেখাতে পারেন।

আমি বুঝতে চাই, ছেলেমেয়েরা ক্লাস ছেড়ে টিউটোরিয়াল হোমে যেতে চায় কেন, তা-ও আবার শুনছি হাজার হাজার টাকা দিয়ে। সেখানে কি তারা এই মেথড বা পদ্ধতির কোনও দিশা পায়? ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন ও আহৃত জ্ঞান বোধহয় স্কুলকলেজের শিক্ষকশিক্ষিকাদের সচেতনতায় যোগ্য মূল্য পায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mobile phone Class Room Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE