Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Narayan Gangopadhyay

মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

মানুষটি বেশ রসিক ছিলেন। নিজেও হাসতেন, অন্যদেরও হাসাতেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতো। এক জন সাহিত্যিকের শিক্ষক হিসাবে জনপ্রিয়তার দৃষ্টান্ত বিরল। শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নয়, তাঁর শিক্ষাদান চলত শ্রেণিকক্ষের বাইরেও।একমাত্র ছাত্র-সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন টিএনজি স্যর। কথাকার, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, টেনিদার স্রষ্টা হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন, তেমন ছিলেন মাস্টারমশাই হিসেবেও। 

 নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্র
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৩:২৯
Share: Save:

‘প্রথম দিন ক্লাশে এসে স্যর আমাকে ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা খাতা আনতে বললেন যা তাঁর নির্দিষ্ট লকার আছে সেখান থেকে। আমি ঘরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজি। স্যরের লকারের সন্ধান পাই না। সকলের নামেই লকার রয়েছে, কেবল স্যরের লকারটি দেখা গেল না। আমি বিমর্ষ হয়ে ফিরে এসে সেকথা জানালাম স্যরকে। স্যর তো শুনে অবাক। সে কী, আমার লকারটাই খুঁজে পেলে না। তারপর ভেবে বললেন কী নাম দেখেছিলে? আমি বলি, কেন আপনার যা নাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। স্যর এবার হাসলেন। তার হাসি তো নয়, ভুবন মন মোহিনী। বললেন, দেখ তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লেখা যে লকার সেটাই আমার। এই প্রথম জানলাম স্যরের ছদ্মনাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।’

গল্পটা শুনিয়েছিলেন আমাদের মাস্টারমশাই বরুণকুমার চক্রবর্তী। প্রকৃতই, সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় বাবা-মায়ের দেওয়া নামটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছাত্র-সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন টিএনজি স্যর। কথাকার, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, টেনিদার স্রষ্টা হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন, তেমন ছিলেন মাস্টারমশাই হিসেবেও।

তাঁর শিক্ষক-জীবন শুরু ১৯৪২-এ, জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে। তার পরে দীর্ঘকাল কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান। আমৃত্যু সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন। অসামান্য বাচনভঙ্গি, কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার ক্ষমতা, দেশি-বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান তাঁকে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা দিয়েছিল।

শিক্ষক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে মুগ্ধতার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নানা কৃতী ছাত্রের কথায়। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত অনার্স ও এমএ, দু’ক্ষেত্রেই নারায়ণবাবুর ছাত্র ছিলেন। অনার্স পড়েছেন সিটি কলেজে। এমএ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জানাচ্ছেন, ‘হলফ করে বলছি, যারা নারায়ণবাবুকে ক্লাশ নিতে দেখেন নি, তাঁরা অনুমানও করতে পারবেন না যে একজন শিক্ষকের জনপ্রিয়তা কোনখানে পৌঁছতে পারে। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন তো দূরের কথা, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও তাঁর ক্লাশে হামলে পড়ত। দশ বা এগারো নম্বর ঘরের করিডোর দিয়ে মাছি গলতে পেতো না।’ নারায়ণবাবুর একদা ছাত্র লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তাঁর মাস্টারমশাইয়ের আশ্চর্য স্মৃতিশক্তির কথা শুনিয়েছেন। লেখকের কথায়, ‘কলেজ ছাড়ার পাঁচ ছ বছর বাদে ওর সঙ্গে এক জায়গায় দেখা। আমার দৃঢ় ধারণা, উনি আমাকে চিনতে পারবেন না। মাত্র বছর দেড়েক ওঁর ছাত্র ছিলুম, পোষ্ট গ্রাজুয়েট ক্লাশও পড়িনি —আমাকে চিনতে পারার কোনো প্রশ্নই ওঠে না— কিন্তু উনি ঠিক আমাকে দেখেই এক নিমেষও চিন্তা না করে বললেন, কি সুনীল কেমন আছো? তারপর আমাদের ব্যাচের অন্যান্য ছেলে—ফণিভূষণ আচার্য, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, শিবশম্ভু পাল প্রভৃতির কথাও জিজ্ঞেস করলেন। আমি স্তম্ভিত।’

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এমন অসাধরণ স্মৃতিশক্তির নানা বর্ণনা ধরা রয়েছে তাঁর একদা সহকর্মী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশীর অনেক লেখাতেও। সহকর্মী বা ছাত্রছাত্রীর লেখা কবিতা একবার শুনে বা পড়ে দীর্ঘদিন পরেও গড়গড় করে বলে দিতে পারতেন।

মানুষটি বেশ রসিক ছিলেন। নিজেও হাসতেন, অন্যদেরও হাসাতেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতো। এক জন সাহিত্যিকের শিক্ষক হিসাবে জনপ্রিয়তার দৃষ্টান্ত বিরল। শিক্ষকতাকেও শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে আর কেউ পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নয়, তাঁর শিক্ষাদান চলত শ্রেণিকক্ষের বাইরেও। আবিষ্কার করেছেন তাঁর ছাত্র, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। বহু কাহিনির চিত্রনাট্যকার নারায়ণবাবুর কাছে সংলাপের পাঠ বুঝে নিতে যেতেন উত্তম কুমার। পাঠ দিতে গিয়েছেন সুচিত্রা সেনের বাড়িতেও।

এর পাশাপাশি অন্য দিকও ছিল। মৃত্যুর তিন বছর আগে অসুস্থ নারায়ণবাবু সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও স্ত্রী আশাদেবীকে নিয়ে উত্তরবঙ্গের বন্যার পরে কলকাতার পথে শোভাযাত্রা করেছিলেন। উদ্দেশ্য, বন্যাপীড়িতদের সাহায্য করা। শ্যামবাজার থেকে মিছিল বেরিয়েছিল। সে দিন প্রচণ্ড রোদ। রোদের মধ্যেই ঘণ্টা চারেক পায়ে হেঁটে ঘুরে নারায়ণবাবু শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

এই ছাত্রদরদী, জনদরদী শিক্ষকের জন্মশতবর্ষ গত বছর নিঃশব্দে পার হয়ে গেল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-একটি সেমিনার, কিছু পত্রিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে বিশেষ সংখ্যার বাইরে আমরা শিক্ষক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে সঠিক মর্যাদা দিতে পেরেছি কি? তাঁর নামাঙ্কিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আজও একটা ‘চেয়ার’ হল না। এ আমাদের আক্ষেপ। লজ্জাও বটে!

লেখক পুরুলিয়ার মহাত্মা গান্ধী কলেজের বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Gangopadhyay Indian novelist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE