Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মোদী প্রতিশ্রুতি পূরণের পথ খোঁজেননি, বললেন কৌশিক বসু

লাভ হয়েছে ওপরতলার

মোদী প্রতিশ্রুতি পূরণের পথ খোঁজেননি, বললেন কৌশিক বসু

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

প্রশ্ন: ভারতীয় অর্থনীতির এখন যে হাল, সাম্প্রতিক অতীতে তার জুড়ি মেলা দুষ্কর। বৃদ্ধির হার মাঝারি বললেও বেশি বলা হয়, কৃষি বিপুল সমস্যায়। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভাল নয়।

কৌশিক বসু: ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে যা বলছ, সেটা ঠিক। কিন্তু, সামগ্রিক বৃদ্ধির হার নিয়ে এখনই খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। সাম্প্রতিকতম সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভারতের জাতীয় আয় বছরে গড়ে ৬.৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। এটাকে খারাপ বলা যায় একমাত্র যদি ভারতীয় অর্থনীতির গত ১৫ বা ২০ বছরের বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তুলনা করি, তবেই। কিন্তু, সামগ্রিক বিচারে, আর্থিক বৃদ্ধির গতি দুনিয়ার সর্বত্রই যে ভাবে শ্লথ হয়েছে সেটা মনে রাখলে ভারতের এই ৬.৬ শতাংশ বৃদ্ধির হারকে খারাপ বলা যাবে না। ভারতীয় অর্থনীতিতে আসল চিন্তার কারণ অন্যত্র। কৃষিক্ষেত্র গভীর সঙ্কটে। অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভাবে যে বৃদ্ধি হচ্ছে, তার সুফল মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না।

প্র: মেক ইন ইন্ডিয়া বা স্টার্ট আপ ইন্ডিয়ার মতো প্রকল্প, নরেন্দ্র মোদী যেগুলোর ওপর খুবই জোর দিয়েছিলেন, সেগুলোর কী অবস্থা?

উ: মেক ইন ইন্ডিয়া সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের রফতানির পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। গত পাঁচ বছরে ভারতের রফতানির গড় বৃদ্ধির হার কার্যত শূন্য। রফতানির পরিমাণ বলতে গেলে বাড়েইনি। ভারতের ক্ষেত্রে এ রকম পরিস্থিতি বিরল। প্রকল্পটা সফল না ব্যর্থ, তা আরও এক ভাবে বোঝা সম্ভব। কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি থেকে। যত পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, সবই বলছে যে ১৯৯১ সালের পর ভারতে কর্মসংস্থানের ছবিটা এত করুণ কখনও হয়নি। শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হারের সরকারি পরিসংখ্যান দেখো, সেখানেও একই ছবি দেখতে পাবে। ফেব্রুয়ারি মাসের ইনডেক্স অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন-এর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ০.১ শতাংশে। অর্থাৎ, শিল্পক্ষেত্রেও বৃদ্ধি নেই। সবটা মেলালে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মেক ইন ইন্ডিয়ায় বিশেষ কিছু হয়নি।

প্র: ২০১৪’র ইস্তাহারে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা প্রতিশ্রুতি ছিল, নরেন্দ্র মোদী কার্যত তার কোনওটাই পূরণ করতে পারেননি। প্রতিশ্রুতিগুলোই কি এমন ছিল যে তা পূরণ করা অসম্ভব?

উ: আমার তা মনে হয় না। এমন কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না যা কোনও সরকারের পক্ষে পূরণ করা অসম্ভব। কী ভাবে প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা হবে, সেই পথ খোঁজার চেষ্টাটাই হয়নি। সেই কল্পনাটাই দেখা গেল না, একটা ছক তৈরির কোনও চেষ্টা হল না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সফল হতে গেলে রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকাটা প্রয়োজন বটে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক ভাবে সফল হয়েছে এমন দেশে, যেমন চিনে, দক্ষিণ কোরিয়ায়, তাইওয়ানে, আর্থিক নীতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের গুরুত্ব দেখলে বুঝবে, সফল নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এই বিশেষজ্ঞদের দক্ষতার ও মতামতের প্রয়োজন কতখানি। আমি মনে করি, ভারতীয় অর্থনীতির সফল হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। বছরে ৮ শতাংশ আয়বৃদ্ধি হতেই পারে, শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল কর্মসংস্থান হতে পারে। কিন্তু, সেটা মুখের কথায় হবে না। তার জন্য টাকার দাম নির্ধারণের যথার্থ নীতি চাই, জরুরি আর্থিক নীতি চাই, বিভিন্ন ধরনের ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা তৈরি করতে হবে। ভারত কিন্তু অতীতে এ কাজটা করতে পেরেছে। ১৯৯৩, ২০০৩ ও ২০০৫ সালে এ ভাবেই অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছিল। আমরা যত দূর পেরেছিলাম, সেটাকে ভিত্তি করে আর এগোতে পারলাম না, এটা খুবই দুঃখের।

প্র: আগে এক দিন আলোচনায় বলেছিলেন, মোদী জমানায় যে দুটো আর্থিক সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষের সমস্যা হয়েছে, সেই নোট বাতিল আর পণ্য ও পরিষেবা কর চালু করায় মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী অনেকখানি আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন।

উ: নোট বাতিল একটা মস্ত ভুল। শুধু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন অর্থনীতিবিদরাই নন, যে কোনও মানুষই একটু স্থির হয়ে ভাবলে এমন নীতি অনুমোদন করবেন না। নোট বাতিলের পক্ষে প্রথম যে কারণটা বলা হয়েছিল, সেটার কথাই ধরো। বলা হয়েছিল, দেশে নকল টাকা ঘুরছে, এই পথে তা নষ্ট করে ফেলা যাবে। সব দেশেই কম-বেশি নকল টাকা চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও, ভারতেও। কিন্তু তা নষ্ট করতে নোট বাতিল আদৌ কার্যকর হতে পারে কি না, ভাবো। নকল টাকা তো আসলে কিছু মূল্যহীন কাগজের টুকরো, যা দিয়ে কেউ তোমার থেকে মূল্যবান জিনিস, যেমন গয়না, জামাকাপড়, এমনকি জমি নিয়ে নেয়। কিন্তু, সেই নকল টাকা দিয়ে তোমার জিনিস কেউ হাতিয়ে নেওয়ার পর যদি সে-নোট ধরার জন্য গোটা অর্থনীতিটাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, তার কোনও মানে হয় না। এটা চোর পালানোর পর দরজায় তালা ঝোলানোর মতোই অবান্তর কাজ।

পণ্য ও পরিষেবা কর সম্পর্কে অবশ্য সেই কথা বলা যাবে না। নীতি হিসেবে ওটা ঠিক। কিন্তু যে ভঙ্গিতে এই করব্যবস্থা চালু করা হল, সেটা দায়িত্বজ্ঞানহীন। তার ফলে অনেকের ক্ষতি হয়েছে— ছোট মাপের উৎপাদন শিল্পের, কৃষকের। অসংগঠিত ক্ষেত্রে মারাত্মক ধাক্কা লেগেছে। এ দিকে শুনছি ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৬ শতাংশ। কিন্তু, কর্মসংস্থান বা কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হারের মতো বিভিন্ন পরিসংখ্যানের সঙ্গে সেই হার মিলছে না। এর থেকেই আমার অনুমান, আর্থিক বৃদ্ধি যেটুকু হয়েছে, সেটা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। বৃদ্ধি হয়েছে আর্থিক সিঁড়ির একেবারে শীর্ষ স্তরে, মধ্যবিত্ত আর গরিব মানুষ সেই বৃদ্ধি থেকে বাদ পড়ে গিয়েছেন।

প্র: বেশির ভাগ মাপকাঠিতেই ইউপিএ-র আমলে পরিস্থিতি বর্তমান জমানার চেয়ে ভাল ছিল। কিন্তু, সেই আমলে অর্থনীতি নিয়ে যেমন গেল গেল রব পড়েছিল, এখন দেখছি আর্থিক ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ অনেক কম। কেন?

উ: সাধারণ মানুষ অর্থনীতির কথা ভাবে মূলত ধারণার ভিত্তিতে। পরিসংখ্যান ছাড়াও সেই ধারণা নির্ভর করে আরও অনেক কিছুর ওপর। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিরক্তি, নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা ইত্যাদি। তা ছাড়াও, আমার বিশ্বাস, ভোটারদের কাছে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল মূল্যস্ফীতির হার। মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি বোঝার জন্য খবরের কাগজ পড়তে হবে না, টেলিভিশনের আলোচনা শুনতে হবে না, থলি হাতে বাজারে গেলেই তা বোঝা যাবে। ইউপিএ-র আমলে মূল্যস্ফীতির হার বেশি ছিল— শুধু ভারতে নয়, গোটা দুনিয়াতেই তখন চড়া মূল্যস্ফীতি হচ্ছিল। তখন বৃদ্ধির হারও অনেক বেশি ছিল। তার মানে, বেশি মূল্যস্ফীতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সামগ্রিক বিচারে আগের তুলনায় ভাল ছিল। কিন্তু, প্রতি দিন বাজারে গেলেই যে হেতু মূল্যস্ফীতির ছেঁকা লাগত, ফলে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের যে গেল গেল ভাবের কথা তুমি বলছ, সেটা বেশি রকম ছিল।

প্র: ২০১৪ সালে একটা বড় উদ্বেগ ছিল দুর্নীতি। নরেন্দ্র মোদীর আমলে কি দুর্নীতির পরিমাণও বাড়ল? মুষ্টিমেয় বড় ব্যবসায়ীর সুবিধা হল?

উ: দুর্নীতি বেড়েছে, বা কমেছে, কোনওটা বলার মতো তথ্যই আমাদের হাতে নেই। তবে, ধারণা তৈরি হয়েছে যে ছোট ব্যবসা, শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি সরকারের মনোযোগ কম। ফলে, যেটুকু বৃদ্ধি হচ্ছে, সেটা আটকে থাকছে একেবারে ওপরের ধাপেই।

প্র: উগ্র জাতীয়তাবাদের ধাক্কায় কি অর্থনীতির প্রশ্নগুলো শেষ অবধি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে?

উ: উগ্র জাতীয়তাবাদের শিকড় অপরের প্রতি বিদ্বেষে। আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে এই বিদ্বেষের সূত্রপাত। আর, যে দেশ বা জাতির প্রতি তীব্র অপছন্দ থেকে এই জাতীয়তাবাদের সূচনা, শেষ অবধি তাকেই নকল করতে থাকে, তার দোষগুলো রপ্ত করতে থাকে উগ্র জাতীয়তাবাদ। দীর্ঘমেয়াদে এই বিদ্বেষে কখনও কোনও ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। অল্প দিনের মধ্যেই জাতীয়তাবাদ হয়ে দাঁড়ায় অন্য ধর্মের প্রতি, অন্য জাতের প্রতি বিদ্বেষ। তার দীর্ঘমেয়াদি ফল হল বিভাজন, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা আর শেষ অবধি ধ্বংস। কিন্তু, এখানে একটা কথা বলতে চাই। যদি আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে না-ও পড়ে, যদি এই বিদ্বেষ শেষ অবধি কোনও আর্থিক ক্ষতি না-ও করে, তবু এই বিদ্বেষ নৈতিক ভাবে অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য। কোনও সভ্য দেশে এই বিদ্বেষের কোনও স্থান থাকতে পারে না। আমি বড় হয়েছি একটা সনাতন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে। মা-বাবার জীবনযাত্রা একেবারেই ট্র্যাডিশনাল ছিল, কিন্তু তাঁরা আমাদের শিখিয়েছিলেন, দুনিয়াটাকে তার যাবতীয় বৈচিত্র সমেতই গ্রহণ করতে হয়। প্রত্যেকের নিজের ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। নাস্তিকদেরও ঈশ্বরে অবিশ্বাস করার সমান স্বাধীনতা থাকতে হবে। আমার মা-বাবা জাতিভেদ প্রথাকে আমাদের ইতিহাসের একটা লজ্জাকর বিষয় বলে মানতেন। বলতেন, এই প্রথাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। ভারত যখন স্বাধীন হয়েছিল, সেই সময়টায় এই ধরনের সেকুলারিজ়ম, সহনশীলতা, প্রত্যেকের প্রতি সমান আচরণের বোধটা আমাদের সামাজিক চিন্তার অঙ্গ ছিল। এই মানসিকতাই ভারতকে গোটা দুনিয়ায় সম্মানের আসন দিয়েছিল। অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিধর হয়ে ওঠার বহু আগেই। এই মূল্যবোধগুলোকে আমরা যদি ভুলে যাই, তা গভীর বেদনার কারণ হবে।

ভারতের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE