Advertisement
০৫ মে ২০২৪

মোদীর হেলিকপ্টারে কেদার যাত্রা এবং বশিষ্ঠমুনির গল্প

টুইটারে অনিত ঘোষ নামে এক তরুণের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই ভুল খেললেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় মাসের বরফ পেরিয়ে গত বুধবার সকালে কেদারনাথের দরজা খোলার পর নরেন্দ্র মোদীই বছরের প্রথম দর্শনার্থী, শিবলিঙ্গে দুধ, মধু ঢেলে রুদ্রাভিষেক সম্পন্ন করেছেন।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৭ ১২:২৫
Share: Save:

টুইটারে অনিত ঘোষ নামে এক তরুণের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই ভুল খেললেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় মাসের বরফ পেরিয়ে গত বুধবার সকালে কেদারনাথের দরজা খোলার পর নরেন্দ্র মোদীই বছরের প্রথম দর্শনার্থী, শিবলিঙ্গে দুধ, মধু ঢেলে রুদ্রাভিষেক সম্পন্ন করেছেন। তার অব্যবহিত পরেই অনিত প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সার, আপনে কেয়া মাঙ্গা ভগবান শিবসে?’ প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ্বস্ত করে তখনই জানিয়েছেন, ‘ভারতকা বিকাশ অউর প্রত্যেক ভারতীয়কা প্রগতি।’

এত বার কেদার গিয়ে শেষে এই! প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে, নব্বইয়ের দশকেও কয়েক বার কেদার গিয়েছেন মোদী। কেদারনাথের মিথটি তাঁর অজানা নয়। জ্ঞাতিবধের পর বিমর্ষ পাণ্ডবরা তখন হিমালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শিবকে তুষ্ট করতে পারলেই তাঁদের প্রায়শ্চিত্ত হবে। শিবও ভ্রাতৃঘাতী পাণ্ডবদের কাছে ধরা দেবেন না বলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এক দিন ভীম হঠাৎ দেখতে পান তাঁকে, শিব সঙ্গে সঙ্গে মোষের রূপ ধরে ছুটে পালাতে যান। ভীম অমনি মোষটিকে প্রবল ভাবে জাপ্টে ধরেন। সেই মোষের কুঁজটিই কেদার।

ভীমের সঙ্গে ঝটাপটিতে মোষটি আহত হল। ফলে, শুশ্রূষার জন্য মহিষরূপী দেবাদিদেবের আহত কুঁজে ঘি মাখানো হল, দেওয়া হল চানা ডাল। সেই ট্র্যাডিশন আজও! কেদারে গিয়ে দশ টাকার পুজোসামগ্রী কিনুন আর একশো টাকার, ঘি আর চানা ডাল থাকবেই। সামনে বসে এবড়োখেবড়ো প্রস্তরলিঙ্গে ঘি মালিশ করবেন আপনি নিজে, পুরোহিত বলাবেন, ‘পাপো(অ)হম্ পাপকর্মাহম্ ... ত্রাহি মাম্।’ মানে, আমি পাপ, আমার কর্ম পাপের জন্ম দেয়, আমার আত্মা পাপে পরিপূর্ণ। হে শিব, আমাকে উদ্ধার করে আমার সব পাপ ধ্বংস কর। রুদ্রাভিষেক নয়, বিশেষ কোনও কামনা পূরণের আর্তি নয়, ঘি মালিশ করে পাপমুক্ত হওয়াতেই কেদারের আসল মাহাত্ম্য। প্রধানমন্ত্রী মন্দিরে আধ ঘণ্টা ঘি মালিশ করেছেন ঠিকই, কিন্তু ভীম, অর্জুনরা পাপক্ষালনের জন্যই শিবের কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ ছিলেন। হস্তিনাপুরের বিকাশ, প্রগতি-টগতি তাঁদের মাথায় আসেনি।

আর, রুদ্রাভিষেকই বা কেন? কেদার মন্দিরের চার পাশে বরফঢাকা পাহাড় থেকে যে ঠান্ডা হাওয়া এসে তীর্থযাত্রীর হাড় কাঁপিয়ে দেয়, সেটির অন্য নাম হাওয়াস্নান। মন্দিরে ঢোকার আগে হাওয়াস্নানেই পুণ্য। কেদারে তাই স্নান-টান না সেরে সটান মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায়।

কেদার-মাহাত্ম্য এ রকমই। তিনি ভক্তকে মন্দাকিনীর ঠান্ডা জলে স্নান করতে বলেন না, যে কেউ তাঁর গায়ে ঘি মাখাতে পারে। কিন্তু রাজার হাতে জ্ঞাতিবধের রক্ত লেগে থাকলে তার থেকেও পালিয়ে যান।

এর পাশে বারাণসীর শিব শুধুই রাজত্ব চান। স্কন্দপুরাণের বয়ান, বারাণসীতে শিব এক বার যুদ্ধে দিবোদাস নামে এক রাজার কাছে হেরে অনুচরদের নিয়ে হিমালয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর গণেশ এবং অন্যরা যুদ্ধে দিবোদাসকে হারান, শিব রাজবেশে পার্বতীকে নিয়ে নগরে প্রবেশ করেন। এক এক জায়গার শিব এক এক রকম।

সবচেয়ে বড় কথা, বারাণসীর শিবের পুরো ক্ষমতাটাই স্বয়ং রামচন্দ্রের সৌজন্যে। তুলসীদাস লিখে গিয়েছেন, বারাণসীতে মুমূর্ষুর কানের কাছে স্বয়ং বিশ্বনাথ গিয়ে রামনাম জপ করেন, তাই মৃত্যুর পর সেই ব্যক্তি মুক্ত হয়, তার আর জন্ম হয় না। কেদারের এই রামভজনা নেই। বিশেষ বিশেষ তিথিতে ডোলি চড়ে আশপাশ থেকে নল দেবী, রামপুর দেবীর মতো গঢ়ওয়ালি গ্রাম্য দেবীরা কেদারদর্শনে আসেন। এই দেবীদের ডোলি প্রথমে নানাবিধ বাজনা বাজিয়ে মন্দিরচত্বরে রাখা হয়। মানে, তীর্থযাত্রীর মতো তাঁরা কেদারদর্শনে এসেছেন। সন্ধ্যায় তাঁরা গর্ভগৃহে ঢোকেন। পরদিন ডোলি বাজিয়ে ফের স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন। কেদারের গর্ভগৃহে লিঙ্গের পিছনের দেওয়ালে তিনটি ছোট্ট খুপরি রয়েছে। তিনটিই স্থানীয় দেবীদের জন্য সংরক্ষিত। গঢ়ওয়ালিরা বলেন, ওই তিন দেবী কেদারের কাছে এসে নিজেদের রিচার্জ করে নেন। কেদার ফি বছর স্থানীয় গ্রাম্য দেবদেবীদের নিজস্ব ক্ষমতা দান করেন।

স্থানীয় দেবদেবীদের ক্ষমতাদানেই শেষ হয় না তাঁর মাহাত্ম্য। হিমালয়ের কেদার গণতান্ত্রিক চেতনায় ঋদ্ধ, পাঁচ জায়গায় ছড়িয়ে দেন নিজস্ব শক্তি। নরেন্দ্র মোদী হেলিকপ্টার থেকে যেখানে গেলেন, সেই কেদারই তো সব নন। মোষরূপী শিবের পিঠের কুঁজ সেখানে। একটু এগিয়ে উখীমঠ থেকে মদমহেশ্বরে গেলে সেই মোষের নাভি। চোপতা থেকে হেঁটে তুঙ্গনাথের মন্দিরে গেলে তার বাহু, রুদ্রনাথে মুখ আর কল্পেশ্বরে জটা। সব মিলিয়ে পঞ্চকেদার। পাঁচটিরই সমান মাহাত্ম্য, উনিশ-বিশ নেই। মোদীর নির্বাচনী ধাম বারাণসীর বিশ্বনাথ শুধুই প্রতিস্পর্ধীহীন রাজকীয় ক্ষমতায় মগ্ন।

কেদার অবশ্য জানেন, ক্ষমতার বেশই সব নয়। নরেন্দ্র মোদী সকালে যে অনাবৃত প্রস্তরলিঙ্গে রুদ্রাভিষেক সম্পন্ন করলেন, তার নাম নির্বাণদর্শন। সন্ধ্যায় এই প্রস্তরলিঙ্গের গায়েই রেশমি কাপড়, মাথায় মুকুট, উপরে রাজছত্রের আরতিদর্শন। নিজের নাম-লেখা দশ লাখি স্যুট পরে যে প্রধানমন্ত্রী ওবামার সঙ্গে দেখা করতে যান, ক্ষমতাধরের বৈভবহীন, অনাড়ম্বর ‘নির্বাণদর্শন’ থেকে তিনি কী শিখলেন, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

ঋষি, মহর্ষি, সপ্তর্ষি, রাষ্ট্রঋষিরা কাশীবাস করে হাজার বার কাশী টু কেদার করলেও আসল ক্ষমতা কেদারের শিবের। স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে বশিষ্ঠ ঋষির গল্প আছে। বশিষ্ঠ বারো বছর হিমালয়ের কেদারে থেকেও তৃপ্ত হলেন না। বারাণসীতে ফিরে এসে প্রতিজ্ঞা করলেন, ফি বছর চৈত্রপূর্ণিমায় কাশী থেকে কেদার যাবেন, পুজো সেরে সে দিনই ফিরে আসবেন। ৬১ বার এ রকম যাতায়াতের শেষে দেবাদিদেব বললেন, বর নাও। বশিষ্ঠ বললেন, বুড়ো বয়সে আর কাশী টু কেদার যাতায়াতের ধকল সহ্য হয় না। শিব বললেন, তা হলে আমি এই বারাণসীতেই থাকব। তবে পুরো মহিমা পাবে না বাপু। আমার ষোলো ভাগের এক ভাগ হিমালয়ের কেদারেই থাকবে। বশিষ্ঠ হেঁটে গিয়েও কেদারকে কাশীতে নিয়ে এসেছিলেন। মোদী হেলিকপ্টারে গিয়েও সেটি পারেননি।

পারার কথাও নয়। পুষ্পক রথে চেপে তীর্থদর্শনে কে যায়? ছাতি-টাতিতে নরেন্দ্র মোদীর ধারেকাছে না থেকেও রাহুল গাঁধী বছর দুয়েক আগে গৌরীকুণ্ড থেকে মন্দাকিনীর বাঁ দিক ধরে, টানা দেড় দিন ট্রেক করে কেদার গিয়েছিলেন। ‘প্রতিটি ভারতীয়ের বিকাশ’ মার্কা ধোঁয়াশা না বুনে তিনি সে দিন স্পষ্ট একটি বার্তা দিয়েছিলেন— গাছ কেটে আর নয় নির্বিচার হোটেল, হেলিপ্যাড। রাস্তা ঝাঁটিয়ে স্বচ্ছ ভারত গড়ার চেয়ে এই পরিবেশ সচেতন ট্রেকিং-বার্তা বিন্দুমাত্র কম গুরুত্বের ছিল না।

পাঁচটি কেদারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় রয়েছে তুঙ্গনাথ। সেখানকার পুরোহিতেরা বলেন, ‘হিমালয় আছে আমাদের মন্দিরের ভিতরেই। মন্দিরে গিয়ে পর্বতকে প্রণাম করতে বললে তো আর আপনারা করতেন না। তাই ভিতরে উনি তুঙ্গনাথ নামে বিরাজমান।’ প্রকৃতি ও দেবাদিদেব একাকার হয়ে যান যে সংস্কৃতিতে, সেখানে কপ্টারে উড়ে গিয়ে স্বচ্ছ ভারতের কোন ধর্ম তিনি পালন করলেন, তা মোদীই জানেন।

শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Kedarnath Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE