জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। পৃথিবীর ২৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এর মধ্যে আন্দাজ ২ কোটি মানুষ প্রবাসী। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য এবং সাহিত্যসম্ভার বিপুল। অথচ নতুন প্রজন্ম বাংলাভাষার প্রতি উৎসাহী ও মনোযোগী নয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি কথাটা নতুন করে পীড়া দিয়ে থাকে। কেন এ রকম ঘটতে পারল, তার পিছনে আর্থ-সামাজিক, এবং রাজনৈতিক, নানা রকম কারণ আছে। পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের প্রসার, হিন্দি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রের প্রভাব, সরকারি ইংরেজি নীতি ইত্যাদি অনেক রকম কথা তার মধ্যে আসতে পারে। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, একটা কথা ঠিক। শুধু রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক চিন্তাবিদদের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ বা বিশ্লেষণ দিয়ে নতুন প্রজন্মের বাঙালিকে বাংলামুখী করা যাবে বলে মনে হয় না। অন্য কিছু দরকার।
কী সেই অন্য কিছু, ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছিল— প্রবাসী বাঙালিরা কিন্তু বাংলা চর্চা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে চলেছেন, তাঁদের মতো করে। অবশ্যই এ চেষ্টাটা বাংলাদেশের মানুষেরই বেশি। মূলত তাঁদেরই চেষ্টায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়াস-এ প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে বাংলার চর্চা শুরু হয়েছে। ইস্ট লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহামের সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমেরিকার দশটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণাকেন্দ্রে বাংলাভাষার চর্চা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষামন্ত্রক সে দেশের বিদ্যালয়ে বাংলা শেখার অনুমতি দিয়েছেন। স্কুল পরিচালনার কাজে বাঙালিরা নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হচ্ছে। চিন, চেক রিপাবলিক, জার্মানিতেও বাংলার চর্চা চলছে। বিদেশি অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদেরও বাংলা চর্চায় টেনে এনেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণায় জড়িত আছেন বহু বিদেশি বিদ্বজ্জন।
আজকাল ৫০/৬০টি অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণে বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কানাডার ‘পূর্বপশ্চিম’ ও ‘নতুন দেশ’, জর্জিয়ার ‘শনিবারের চিঠি’ ও ‘মানচিত্র’, টরন্টোর ‘সাতদিন’ ও ‘প্রবাসী কণ্ঠ’, আরবের ‘প্রবাসের প্রহর’ অস্ট্রেলিয়ার ‘আমার দেশ’, সিয়োলের ‘বাংলা টেলিগ্রাফ’, লন্ডনের ‘জনমত’ ও ‘সত্যবাণী’— এ সব পত্রিকায় বাংলায় সংবাদের সঙ্গে বাংলার শিল্পসাহিত্য চর্চাও চলে।
প্রবাসে বাংলা চর্চার ধরনটা বোঝাতে টরন্টোর দৃষ্টান্তটি সহায়ক হতে পারে। ২০১৪ থেকে তোড়জোড় শুরু করে ২০১৬ সালে সেখানে জন্ম নিয়েছিল ‘বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার’। বাঙালি লেখকদের পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। কাজ শুরু করে তারা লক্ষ করে কানাডায় এক লক্ষ বাঙালি থাকলেও তাঁদের মধ্যে মেলবন্ধনের কোনও ব্যবস্থা নেই, বাঙালি পরিবারের সন্তানদের বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি শেখানোর ব্যবস্থা তো নেই-ই। এই সংগঠন অভিবাসী বাঙালি লেখকদের যেমন একত্র করতে চাইল, তেমনই চাইল তরুণ প্রজন্মের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি পৌঁছে দিতে।
কেবল তা-ই নয়, কানাডীয় লেখকদের সঙ্গে বাঙালি লেখকদের সংযোগ স্থাপনও একটা দরকারি কাজ বলে মনে করল।
বাংলাকে কেন্দ্র করে এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মধ্যে অনেকগুলো নতুন ভাবনা উঠে এল। কেবল এই বিশেষ সংগঠনটির উদ্ভাবন নয়, প্রবাসী সংগঠনগুলির অনেকেই এখন এমন বিবিধ অভিনব পথে ভাবনাচিন্তা করে চলেছে। বাংলা ও ইংরেজিতে বই ও পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে চেষ্টা চলছে— প্রথমত, শুদ্ধ ভাবে বাংলা লেখা শেখানোর কর্মশালা, এবং দ্বিতীয়ত, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় বাড়ানোর জন্য কোনও ছুতমার্গ না রেখে ইংরেজির সাহায্য নেওয়া। বাস্তবিক, সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য এবং চমকপ্রদ প্রকল্পটি হল— তরুণদের জন্য ইংরেজি ভাষায় বাংলা সাহিত্য পাঠ! শুনলেই প্রথমে মন বিদ্রোহ করে ওঠে। কিন্তু সত্যিই যদি লক্ষ্য হয় বাংলার সাহিত্যের সঙ্গে গভীরতর পরিচয়, তা হলে কিন্তু বলতে হবে, লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথটি যথেষ্ট সফল। এই সাহিত্য পাঠ প্রকল্পে যে হেতু থাকত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, মীর মশাররফ হোসেন, সুকুমার রায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লা্হ, শামসুর রহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, এঁদের নানা ধারার নানা স্বাদের লেখা, বিচিত্র সাহিত্যানুরাগ মেটানো যেত তাতে। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারীরা প্রতি মাসে দু’টি করে বই নিতেন। বছরশেষে পাঠ নিয়ে মূল্যায়ন জমা দিতে হত তাঁদের। সেরা দশটি মূল্যায়ন নিয়ে প্রকাশ করা হত এক স্মরণিকা। আর সেরা তিন মূল্যায়নকারীকে পুরস্কৃত করা হত।
ভাবছিলাম, যে বাঙালি ছেলেমেয়েরা কলকাতা বা ঢাকায় বসেও কোনও দিন বাংলা বই পড়তে চায় না কিংবা পারে না, এই পাঠপ্রকল্প কি তাদের জন্য ভাবা যায়? ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে কি চালু করা যায় এমন কিছু? না-ই বা গেল বাংলা ভাষা ও লিপি বাঁচানো, বাংলার সাহিত্য হয়তো তাতে বাঁচত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy