নজির: সুয়াবাসার নতুন তৈরি শাল জঙ্গল। নিজস্ব চিত্র
বহু বছর আগে এক বন আধিকারিক পথ দেখিয়েছিলেন। সেই সত্তরের দশকে। ওই বনাধিকারিকের নাম অজিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। মেদিনীপুরের ডিএফও ছিলেন তিনি। সেই সময়ের শালবনির আরাবাড়ি অঞ্চলে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আরাবাড়ির জঙ্গল শেষ ওই এলাকায় জঙ্গল শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা সেই বনাঞ্চলকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বন বাঁচানো এবং বনাঞ্চলের বাসিন্দাদের উন্নয়নের পথ দেখিয়েছিলেন। আরাবাড়ি এখন সারা বিশ্বের মডেল।
বন দফতর দক্ষিণবঙ্গে শাল চারার বাগান তৈরি করার জন্য প্রায় বছর কুড়ি চেষ্টা করছে। সময়কাল তার বেশিও হতে পারে। কিন্তু সাফল্যের হার অত্যন্ত কম। ব্যর্থতাই যেখানে বেশি সেখানে উজ্জ্বল উদাহরণ ঝাড়গ্রাম শহর লাগোয়া প্রায় পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে কৃত্রিম শাল বাগান। এই কৃত্রিম শাল বাগানের অন্য গুরুত্ব রয়েছে। ঝাড়গ্রামে বছর দুয়েক হল বহু শাল গাছ কাটা পড়েছে। বাসিন্দা এবং পরিবেশ কর্মীরা বারবার অভিযোগ করছেন, এই ভাবে চললে খুব শীঘ্রই ঝাড়গ্রাম অরণ্যসুন্দরীর মর্যাদা হারাবে। এই পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রামের এক অঞ্চল অরণ্যসুন্দরীর মানরক্ষায় লড়ছে।
জায়গাটা ঝাড়গ্রামের উপকণ্ঠে। রাধানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে সুয়াবাসা গ্রাম। এই গ্রামের পাশেই ৩৭৫ বিঘা অর্থাৎ পঞ্চাশ হেক্টর বনভূমি পতিত অবস্থায় পড়ে ছিল দীর্ঘ কয়েক দশক। এই জমির চারিদিকে রয়েছে এক ফসলি জমি, গ্রাম এবং পতিত জমি। রয়েছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসিন্দা। তফসিলি উপজাতি, তফসিলি জাতি, ওবিসি-সহ সাধারণ শ্রেণির মানুষের গ্রামগুলোতে বাস। তাঁরা কেউ চাষি, কেউ ক্ষেত মজুর, কেউ শ্রমজীবী। সরকারি চাকুরীজীবীদের সংখ্যা নগণ্য। ফলে গ্রামের অর্থনীতির হালটা মোটামুটি সহজবোধ্য।
গ্রামের প্রকৃতি বদলের সুযোগটা এল ২০০৭-২০০৮ সাল নাগাদ। হঠাৎ ত্রিশ হেক্টর এবং কুড়ি হেক্টর কৃত্রিম শাল বাগান করার বরাদ্দ এল বন দফতরের কাছে। কাজ শুরু করল দফতর। শুরু হল গাছ লাগানো। এক হেক্টরে প্রায় ১৬০০ মতো চারাগাছ দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে আড়াই মিটার ব্যবধানে লাগানো হল। বাগানে চারার ষাট শতাংশ শালের। চল্লিশ শতাংশ অন্য প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া বনের চারা। সেগুলো হল, আমলকি, হরিতকি, বহেরা, নিম, অর্জুন, ওলোট কম্বল, লোধ, পিয়াশাল, মহুল, কেন্দ। এ ছাড়াও বহু ধরনের গাছ লাগানো হল। বাগান তৈরির কাজ শুরু হল সেই জানুয়ারি মাস থেকে। প্রথমে গর্ত খোঁড়া হল। জল ধরে রাখার পরিখা খনন হল। চারিদিকে করা হল সীমানা। সেই সঙ্গে সারের ব্যবস্থা করা। বৃষ্টি আসার আগে গর্ত মাটি দিয়ে ভর্তি। তার পর ভরা বৃষ্টিতে চারা লাগানো।
চারা লাগানোর পরে ওষুধ প্রয়োগ প্রয়োজন। দরকার সার দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার, গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষা ইত্যাদি। সে এক যজ্ঞের আয়োজন। আরেক যজ্ঞ হল চারা গাছ তৈরি। অভিজ্ঞতা বলে, শাল এবং বেশ কিছু চারা ২-৩ বছরের বেশি বয়সের হলে ভাল হয়। বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ এই চারা তৈরির প্রস্তুতি ২-৩ বছর আগে থেকে শুরু করতে হয়। শাল চারা প্রথম দুই-তিন বছর বেশি আলো পছন্দ করে না। আর পতিত, রুক্ষ জমিতে গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার থাকে না। মাটির ধরনের জন্য গাছের বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপাদান পাওয়া যায় না। এই দুই কারণে বন দফতর অড়হড় বীজ গাছের উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বপন করে। শাল গাছের খুব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হয়। আর তারা বেশি গরম, আর্দ্রতাহীন মাটি প্রথম কয়েক বছর পছন্দ করে না। ফলে সময় মতো বৃষ্টি না হলে ডিসেম্বর–জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করে প্রায় জুন মাস অবধি চারা গাছে জল দিতে হয়। দীর্ঘ সীমানা পায়ে হেঁটে একটি বা দু’টি কর্মচারীর কাছে এদের রক্ষা করা এক অগ্নি পরীক্ষা। দরকার আন্তরিকতা, নিরলস পরিশ্রম, আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আর এই সম্পদ নিজের মতো করে ভাবার মানসিকতা। কয়েক ঘণ্টার শৈথিল্য বাগান শেষ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
চারা গাছ লাগানো সোজা কিন্তু তাদের মানুষ, গরু-ছাগল, প্রকৃতির হাত বাঁচিয়ে রেখে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে পরিণত করা সহজ কাজ নয়। কোনও ভাবে একবার চারা গাছের মাথা শুকনো হলে বা গবাধি পশু খেয়ে গেলে আর সে গাছ সোজা হয়ে দাঁড়াবে না। তৈরি হবে ঝোপ বা ডালপালা নিয়ে একটি বনসাইয়ের চারা। তা ছাড়া দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে এমন সব স্তরের কর্মীর বর্তমানে খুব অভাব। আরও কিছু সমস্যা তো ছিলই।
প্রথম বছর প্রায় ৪৮ হাজার চারা গাছ লাগানো হয়। প্রচণ্ড গরমে জল দেওয়ার জন্য অগভীর নলকূপ করে জেনারেটার চালিয়ে সারা রাত প্রথম দু’বছর জল দিতে হয়েছে। গ্রীষ্মে প্রচুর শুকনো আগাছায় সামান্য অসাবধানতায় একদিন আগুন লেগে গেল। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া গেল। খবর গেল দমকলে। সামান্য অংশ পুড়ল বটে। কিন্তু বেঁচে গেল চারা বাগান।
টানা দু’বছর বনকর্মীদের পরিশ্রম আর স্থানীয় বন সুরক্ষা কমিটির সহযোগিতায় তৈরি হয়ে গেল কৃত্রিম শাল বাগান। বন দফতরে বহু বছর কাজ করা কর্মীও বিশ্বাস করতে পারেন না প্রায় দুই দশক আগে এই জায়গাটা রুক্ষ, পতিত, পাথরের মতো শক্ত মাটি নিয়ে অবহেলায় পড়ে ছিল। এখন এই শাল জঙ্গলে কত হারিয়ে যাওয়া গাছ-গাছালি। সাপ, খরগোশ নানান পাখি এমনকি বুনো শুয়োর ধীরে ধীরে আস্তানা তৈরি করেছে। আবির্ভাব ঘটেছে। বন দফতরের বেশ কিছু জায়গায় দায়িত্ববান কর্মী এখনও নিজের মতো করে এই ধরনের চারা বাগান তৈরি করছেন।
এ তো গেল পরিবেশগত দিক। কিন্তু মানুষের কাছেও তো গুরুত্বপূর্ণ সুয়াবাসার শালবাগান। নতুন জঙ্গল বন কর্মীদের কাছে শিক্ষণীয় স্থান। আর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কিছুটা হলেও উপার্জনের পথ। কারণ জঙ্গল তৈরিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে লাগানো হয়েছিল। তাতে কর্মদিবস তৈরি করা গিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে বনসুরক্ষা কমিটি। যে কমিটির সদস্যরা বুক দিয়ে জঙ্গল আগলাচ্ছেন। আরাবাড়িতেও বন আগলেছিলেন বাসিন্দারাই।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত সহকারী বিভাগীয় বন আধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy