Advertisement
০৫ মে ২০২৪
বাহ্যিক অমিল নয়, ভেতরের সামঞ্জস্যেই যেন আমরা জোর দিই

ন্যাশনালত্বের মঙ্গল কিসে

রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীক্ষার মধ্যে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সেই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মানবতাবাদ, শান্তি এবং সৌভ্রাতৃত্বের ভাবনার সঙ্গে জড়িত। তিনি ছিলেন জাতিগত বিভেদের কঠোর ও ধারাবাহিক সমালোচক। তিনি মনে করতেন, বিশ্ব জুড়ে যে মতবিরোধ, এটাই তার অন্যতম কারণ।

শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সুরঞ্জন দাস
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:৫০
Share: Save:

সাহিত্য, দর্শন, শিক্ষা, সংগীত, চারুশিল্প ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র সংক্রান্ত ভাবনা নিয়ে আলোচনার ঝোঁক হয়েছে আজকাল। তবে রাষ্ট্র ও ভারত বিষয়ে রবীন্দ্রচেতনা সম্পর্কে মনে হয়, আরও একটি বিষয়ে আলোচনা জরুরি— সেটা হল, ভারতের বাইরে যে জগৎ, বা যাকে বলা যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, তাকে রবীন্দ্রনাথ কী চোখে দেখতেন।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীক্ষার মধ্যে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সেই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মানবতাবাদ, শান্তি এবং সৌভ্রাতৃত্বের ভাবনার সঙ্গে জড়িত। তিনি ছিলেন জাতিগত বিভেদের কঠোর ও ধারাবাহিক সমালোচক। তিনি মনে করতেন, বিশ্ব জুড়ে যে মতবিরোধ, এটাই তার অন্যতম কারণ। সাম্রাজ্যবাদ বা ইম্পিরিয়ালিজম-এর সার কথা কী, এই প্রশ্নে তাঁর বিশ্লেষণ— ‘ব্যক্তিগত ব্যবহারে যে-সকল কাজকে চৌর্য মিথ্যাচার বলে, যাহাকে জাল, খুন ডাকাতি নাম দেয়, একটা ইজ‌ম্-প্রত্যয়-যুক্ত শব্দে তাহাকে শোধন করিয়া কতদূর গৌরবের বিষয় করিয়া তোলে, বিলাতি ইতিহাসের মান্যব্যক্তিদের চরিত্র হইতে তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়।’

পাশ্চাত্যের এই সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার তীব্র সমালোচনা করেন গুরুদেব ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’র অক্টোবর ১৯২৫ সংখ্যায়। অবশ্য পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদানগুলিকে কোনও দিন তিনি অস্বীকার করেননি: ‘উহা পাশ্চাত্যের ‘নেশনের’ সৃষ্টি নহে, উহা পাশ্চাত্যের জনগণের সৃষ্টি এবং উহাকে আমাদের গ্রহণ করিতে হইবে।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র নিয়ে তিনি ছিলেন সজাগ। যুদ্ধশেষে বিজয়ী শক্তিজোট ভার্সাই চুক্তি ও লিগ অব নেশন্‌স-এর মাধ্যমে পরাজিতদের উপর নতুন শর্ত চাপিয়ে দিলে তিনি তার সমালোচনা করেন। ১৯২০-র ২১ ডিসেম্বর আক্ষেপ করে বন্ধু এন্ডুজ-কে চিঠি দেন, ‘I do not belong to the present age, the age of conflicting politics. ...I crave for freedom and yet am held back. ’

কোনও একটি ধর্ম বা দর্শনকে শ্রেষ্ঠ বা আসল বলে প্রমাণ করার প্রবণতাকে রবীন্দ্রনাথ ঘোরতর অপছন্দ করতেন। তিনি তাই চেয়েছিলেন, আমাদের মনের সেই দৃষ্টি গড়ে উঠুক, যা দিয়ে যারা আমাদের থেকে দূরে রয়েছে, তাদেরও আমরা বুঝতে পারি। তিনি বার বার বলেছেন, ভিন্ দেশের বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যকে উপেক্ষা করে বাহ্যিক অমিলকেই আমরা যেন জোর না দিই। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, রবীন্দ্রনাথ যখন ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করছেন, তখন অন্যান্য দেশে ঔপনিবেশিক শোষণের ঘটনা তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘আফ্রিকা’ কবিতা তাঁর এই বিষয়ে ভাবনার উদাহরণ।

আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে জওহরলাল নেহরু যতটা সুশৃঙ্খল ভাবে লিখেছেন, গুরুদেব সম্ভবত ততটা লেখেননি। কিন্তু তাঁর মতো বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানো মানুষ সে কালে খুব কমই ছিল। প্রথম বার তিনি ইংল্যান্ডে যান ইতালি থেকে— রেলপথে প্যারিস হয়ে লন্ডন। তিনি অন্তত তিন বার আমেরিকা গিয়েছেন, ১৯২৪ সালে তিনি কয়েক মাস আর্জেন্তিনায় কাটিয়েছিলেন, ১৯২৯ সালে তিনি কানাডায় একটি আলোচনা চক্রে যোগ দেন, আর এশিয়ার মধ্যে তিনি যান মায়ানমার, মালয়েশিয়া, জাভা ও সিয়াম। ১৯৩২ সালে তিনি যান পারস্য আর ইরাকে। রবীন্দ্রনাথ জাপানে গিয়েছেন অন্তত তিন বার। ১৯২৪ সালে তিনি চিন ঘুরে আসেন। শ্রীলঙ্কাতেও গিয়েছেন ১৯৩৪ সালে। এই সব যাত্রায় তিনি অজস্র বক্তৃতা দিয়েছেন আর সবিস্তার লিখেছেন তাঁর ভ্রমণের কাহিনি। সেই সব বক্তৃতা আর ভ্রমণ বৃত্তান্তে আমরা দেখতে পাই যে, রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বিশ্বমানবতার ওপরে জোর দিচ্ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতাবাদের ভাবনাটি অনেকাংশেই তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধিতার মধ্য থেকে উঠে আসে। এই কথাটি আজ বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। তখন পশ্চিমে নগ্ন জাতীয়তাবাদের জয়গান চলছে, আর তিনি এই আদিম জাতীয়তাবাদের ধ্বংসাত্মক পরিণতির বিষয়ে বার বার সতর্ক করছেন। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে শান্তিনিকেতনে একটি ভাষণে বিকৃত জাতীয়তাবাদকে কঠোর ভর্ৎসনা করলেন, ‘মানুষের জাতীয়তা, ইংরেজিতে যাতে nationality বলে, ক্রমশ উদ্‌ভিন্ন হয়ে উঠেছে এই জন্য যে তার মধ্যে মানুষের সাধনা মিলিত হয়ে মানুষের এক বৃহৎ রূপকে ব্যক্ত করবে। ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে প্রত্যেক মানুষকে মুক্ত করে বৃহৎ মঙ্গলের মধ্যে সকলকে সম্মিলিত করবে। কিন্তু সেই তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্যে শয়তান সেই জাতীয়তাকেই অবলম্বন করে কত বিরোধ, কত আঘাত, কত ক্ষুদ্রতাকে দিন দিন তার মধ্যে জাগিয়ে তুলছে। ...আমি সত্য, আমি সত্য, এই কথা জানবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগ হোক। জাতীয়তার আবরণ, বিশেষ ধর্মের গণ্ডি, সাম্প্রদায়িত সংকীর্ণতা,
এ সমস্ত থেকে মুক্তি লাভ করি।’ উগ্র জাতীয়তাবাদ নেশা বা মাদকের মতো, মানুষের যুক্তিবোধ ও বোধশক্তিকে তা আচ্ছন্ন করে দেয়: ‘ন্যাশনালিজম’ বইতে লিখলেন তিনি।

আজ আমরা ক্রমশ বুঝতে পারছি যে, সামরিক শক্তি, শক্তির ভারসাম্য এবং কৌশলগত নিরাপত্তার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার, লিঙ্গসাম্য এবং পরিবেশ রক্ষার মতো মানবিক নিরাপত্তার বিষয়গুলি যুক্ত করেই সামগ্রিক নিরাপত্তার ভাবনাটি গড়ে তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অত দিন আগেই ‘দেশের কথা’য় লিখলেন: ‘এ কথা যেন মনে না করি; জাতীয় স্বার্থতন্ত্রই মনুষ্যত্বের চরম লাভ। তাহার উপরেও ধর্মকে রক্ষা করিতে হইবে। মনুষ্যত্বকে ন্যাশনালত্বের চেয়ে বড়ো বলিয়া জানিতে হইবে। ...মনুষ্যত্বের মঙ্গলকে যদি ন্যাশনালত্ব বিকাইয়া দেয়, তবে ন্যাশনালত্বের মঙ্গলকেও একদিন ব্যক্তিগত স্বার্থ বিকাইতে আরম্ভ করিবে।’ এখানেই লুকিয়ে আছে, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ‘বিশ্ব জাগতিকতার আদর্শ’টিকে তুলে ধরার প্রবল প্রয়োজনটি।

আবার, আজ আমরা যাকে নরম কূটনীতি (soft power diplomacy) বলছি, তার সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের সুসংবদ্ধ বিশ্ব ভাবনার সম্পূর্ণ ঐক্য রয়েছে। স্বাধীন ভারতের বিদেশনীতির রূপকার জওহরলাল নেহরু রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের বানদুং সম্মেলনে নেহরুর সেই ঐতিহাসিক মন্তব্যটি উদ্ধৃত করছি: ‘We should not increase the feeling of dislike and hatred. If you do things in the right manner, people will respond, and you will have good result.’ রবীন্দ্রনাথ যে দ্বন্দ্ব-মুক্ত বিশ্বের কথা ভেবেছিলেন, নেহরুর এই মন্তব্যে তারই প্রতিফলন। স্বাধীন ভারতের বিদেশনীতির মূল রূপরেখাটি এই ভাবনা অনুযায়ীই তৈরি হয়েছিল। তার ফলও পরিষ্কার। প্রায় একই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করা দেশগুলির তুলনায় বিশ্ব দরবারে ভারত অনেক বেশি শক্তিশালী, সম্মাননীয় বলে গণ্য হয়।

সুতরাং, আজ আমাদের কাজ, প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকা যাতে ভারতীয় রাষ্ট্র তার বিদেশনীতির এই মূল তত্ত্বে অনড় থাকে, যাতে পররাষ্ট্র নীতিতে আমাদের এত দিনের বৈশিষ্ট্য খর্ব না হয়। সহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই যেন বিদেশনীতি পরিচালিত হয়। সংঘাতের পরিস্থিতিতেও ভারত যাতে প্রতিশোধের পথে না হাঁটে। নাগরিক সমাজকেই এ বিষয়ে সর্বদা লক্ষ রাখতে হবে।

এখনকার চিন্তাবিদরা বলেন, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিতে হবে এমন ভাবে যাতে তারা কখনও না মনে করে যে তারা কেবল একটি দেশের নাগরিক। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ইউনিভার্সাল ম্যান’ বা সার্বিক মানুষ-এর ভাবনা। তিনি এমন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে নাগরিকরা নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও জাতীয়, আঞ্চলিক বা গোষ্ঠী-গণ্ডির সীমানা ছাড়িয়ে সার্বিক পরিচিতি ও মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হবে। আজকে বিশ্বব্যাপী যখন মুক্ত ভাবনা ও যুক্তির সংস্কৃতি ক্রমশই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তখন তাঁর এই সর্বজনীন নাগরিক সমাজের কল্পনা খুবই প্রাসঙ্গিক। মানবতার প্রতি তাঁর পরম আস্থা, এই বিশ্বকে বসবাসের পক্ষে আরও উপযুক্ত করে তোলার জন্য তাঁর ভাবনা, সেগুলো আজ আবার জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে।

ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranah Tagore Religion Nationality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE