Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শুধু আইন নয়, শিশুশ্রম বন্ধে সচেতনতাও জরুরি

বহু ক্ষেত্রে, দরিদ্র পরিবারের সন্তান বিদ্যালয়ে নিচু শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই দোকান, ইটভাটা, কয়লাখনি, গৃহনির্মাণের মতো নানা কাজে যুক্ত হয়ে যায়। স্কুলছুট ও নাবালিকা বিবাহের হাত ধরেই পরোক্ষ ভাবে শিশুশ্রমের সূত্রপাত। আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিরোধী দিবস লিখছেন সুকমল দালালআন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জানাচ্ছে, যদি কোনও কাজের ফলে শিশুকে তার শৈশবের স্বাভাবিক চাহিদাগুলি থেকে বঞ্চিত হতে হয়, স্কুলের শিক্ষালাভ থেকে সে যদি বঞ্চিত হয় এবং মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক ভাবে তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তা হলে সেই কাজটিকে ‘শিশুশ্রম’ বলা হবে।

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৯ ০১:০৪
Share: Save:

ফি-বছর নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আমরা মে দিবস পালন করি। শ্রমিকের সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের আলোচনা, লেখালেখি, আন্দোলন— সবই হয়। আর সেই প্রসঙ্গেই উঠে আসে শিশু শ্রমিকদের কথা। শিশুশ্রম বন্ধ করতে, শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে নানা দেশে আইন তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। তবুও আমাদের দেশে আজও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় এক কোটিরও বেশি। এই শিশু শ্রমিকদের কথা আরও এক বার আলোচনায় উঠে আসে আজকের দিনটিতে। কারণ আজ, ১২ জুন দিনটি সমগ্র বিশ্বজুড়ে ‘আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।

অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের পরে গোটা ইউরোপ ও আমেরিকায় কলকারখানা তৈরি হতে থাকে। এই সময় আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা এবং প্রযুক্তির হাত ধরে বেড়েছিল জনসংখ্যাও। গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ কলকারখানায় আসতেন কাজের খোঁজে। এই সময়ে মালিকেরা দেখলেন এক জন পূর্ণবয়স্ক শ্রমিককে বেতন দিয়ে কাজ করিয়ে যতটা লাভ হচ্ছে তার থেকে অনেক কম বেতনে শিশু ও মহিলা শ্রমিকদের কাজে রাখা যায়। এবং তাদের দিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছা কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। তাতে লাভ বাড়ে। পাশাপাশি, শ্রমিক পরিবারগুলিও এটা মেনে নিতে বাধ্য হত। কারণ, মূল শ্রমিকের যে সামান্য মজুরি মিলত তাতে ঠিকমতো সংসার চলত না। ফলে, পরিবারের ছোটদের এক প্রকার বাধ্য হয়ে অমানবিক পরিবেশে কাজে পাঠাতে হত। তথ্য বলছে, শিশু শ্রমিকদের ফি-দিন সামান্য মজুরি দিয়ে ১৬ ঘণ্টার কাছাকাছি কাজ করানো হত। এর জেরে শিশুরা অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগত। অমানবিক খাটুনিতে শরীরও দ্রুত ভেঙে পড়ত। সেই সময়ের সাহিত্যে, যেমন, চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসে শিশুশ্রমের এই ছবিটি দেখতে পাওয়া যায়।

তবে সভ্যতার আদিকাল থেকেই, যখন থেকে দাস ব্যবসা একটি লাভজনক বৃত্তিতে পরিণত হয়েছিল তখন থেকেই শিশুশ্রমের ব্যবস্থা মানব সমাজে প্রচলিত হয়। আমাদের হরিশ্চন্দ্রের আখ্যানে শিশুদের বাড়ির কাজে ও শস্যক্ষেত্রে লাগানোর কথা আছে। রোমান সভ্যতায় ক্রীতদাসের মধ্যে একটি অংশ ছিল শিশু। ঔপনিবেশিক সময়ে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিশুদের সংগ্রহ করে দাস হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে চালান করে দেওয়া হত।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জানাচ্ছে, যদি কোনও কাজের ফলে শিশুকে তার শৈশবের স্বাভাবিক চাহিদাগুলি থেকে বঞ্চিত হতে হয়, স্কুলের শিক্ষালাভ থেকে সে যদি বঞ্চিত হয় এবং মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক ভাবে তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তা হলে সেই কাজটিকে ‘শিশুশ্রম’ বলা হবে। এই সংজ্ঞায় আরও বলা হয়েছে, ৫-১১ বছরের বাচ্চা দৈনিক এক ঘণ্টা কাজ করলে ও ১২-১৪ বছরের শিশুরা সপ্তাহে ১৪ ঘন্টা কাজ করলে তাকে শিশুশ্রমকি হিসেবে গণ্য করা হবে।

১৯১৮-১৯২০ সালের দিকে আমেরিকায় শিশুশ্রমকে ‘বেআইনি’ ঘোষণার চেষ্টা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৮ সালে সরকারি ভাবে শিশুশ্রমিক নিয়োগ বেআইনি ঘোষিত হয়। পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও শিশুশ্রম বন্ধের জন্য নানা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ভারতবর্ষের প্রচলিত আইন অনুসারে ১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয়। তবে তথ্য বলছে, এখনও ভারত, নাইজেরিয়া, মায়ানমার, সোমালিয়া, কঙ্গো, লাইবেরিয়া, পাকিস্তান, চাদ, বাংলাদেশ, ইথিওপিয়া প্রভৃতি দেশগুলিতে কোথাও সরাসরি কোথাও ঘুরপথে শিশু শ্রমিককে কাজে লাগানো হয়। এর একটি কারণ অবশ্যই দারিদ্র। দরিদ্র পরিবারে এই কারণে সন্তানের সংখ্যা বেশি হয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। কারণ, পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়া মানে কাজ করার লোকের সংখ্যাও বাড়া। এর পাশাপাশি, সচেতনতার অভাব এবং আইনের প্রয়োগের শৈথিল্য তো রয়েই গিয়েছে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তান বিদ্যালয়ে নিচু শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই দোকান, ইটভাটা, কয়লাখনি, গৃহনির্মাণের নানা কাজে যুক্ত হয়ে যায়। কয়েক জন কাজের ফাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও অধিকাংশের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। এক সময়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি কাজে নেমে যায় অনেকে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই! অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে পরের বাড়িতে খাটতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই স্কুলছুট ও নাবালিকা বিবাহের হাত ধরেই পরোক্ষ ভাবে শিশুশ্রমের সূত্রপাত। এই সমস্যাকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা প্রয়োজন।

সরকারি যে উদাসীন তা কিন্তু বলা যাবে না। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি, শিশুদের স্কুলমুখী করে তুলতে বিভিন্ন নানা সরকারি প্রকল্প রয়েছে। স্কুলে মিড-ডে মিল চালু হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে বিনা পয়সায় খাতাবই এমনকি, স্কুল ড্রেসও দেওয়া হচ্ছে। ‘কন্যাশ্রী’, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’-এর মতো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে হয়েছে। কৈলাস সত্যার্থীর মতো মানুষ ৩৮ বছর ধরে শিশুদের জন্য ‘বচপন বাঁচাও’ আন্দোলন করেছেন। এই কাজের জন্য নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু সমস্যা এত গভীরে যে এর পরে আরও সক্রিয়তার প্রয়োজন। শুধু সরকার নয়, দরকার নাগরিক সচেতনতারও।

খণ্ডঘোষের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Awareness Child Labor Law
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE