Advertisement
০৫ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মাওবাদীরা এখন ‘ভুল স্বীকার’ করছেন

নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের পঞ্চাশ বছর হতে চলল, কোনও শিক্ষা নেওয়া গেল না? কেন বার বার একই ভুল হয়, যার পরিণামে শাস্তি পায় সাধারণ মানুষ এবং তরুণ কমরেডরা?স ম্প্রতি সিপিআই (মাওবাদী) রাজ্যের জঙ্গলমহলে তাদের ভুলগুলির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। পাঁচ রকম ভুল। পাঁচ দফা ‘আত্মসমালোচনা’। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘পার্টি প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের কাছে’ পেশ করা প্রচারপত্রে দল ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি আর না করার অঙ্গীকার করেছে।

পিএলজিএ। সিপিআই (মাওবাদী)-র গেরিলা সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস। পালামু, ২০০৭

পিএলজিএ। সিপিআই (মাওবাদী)-র গেরিলা সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস। পালামু, ২০০৭

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

স ম্প্রতি সিপিআই (মাওবাদী) রাজ্যের জঙ্গলমহলে তাদের ভুলগুলির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। পাঁচ রকম ভুল। পাঁচ দফা ‘আত্মসমালোচনা’। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘পার্টি প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের কাছে’ পেশ করা প্রচারপত্রে দল ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি আর না করার অঙ্গীকার করেছে।
২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গঠিত হওয়ার পর থেকে সিপিআই (মাওবাদী) নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ওডিশা এবং ঝাড়খণ্ডে। এ রাজ্যে ২০০৮ থেকে তাদের কাজকর্মের প্রভাব পড়লেও ২০০৯ থেকে অর্থাৎ নন্দীগ্রাম পর্বে এবং তার পরে লালগড়ের আন্দোলনে তাদের কথা শোনা যেতে থাকে। মিলিটারি পোশাক পরা, আধুনিক অস্ত্রচালনায় পারদর্শী কিছু লাল কমরেড এসে পড়লেন জঙ্গলমহলের নিরীহ দুঃস্থ-শোষিত-অত্যাচারিত ভূমিসন্তানদের ত্রাতার ভূমিকায়। বেছে নিলেন সেই সত্তর সালের পথ। আবার শুরু বেপরোয়া খতমের অভিযান। কেন্দ্রীয় বাহিনী দমন-পীড়ন শুরু করল। আবার এর পাল্টা হিসেবে যৌথবাহিনীর ওপর আক্রমণ, পুলিশের চর সন্দেহে শিক্ষক খতম, এলাকার প্রভাবশালী সিপিএম নেতাকে খতম বা গায়েব করা শুরু হল। রাষ্ট্রের বাহিনীকে বেপরোয়া আক্রমণ করে কেউ তাদের কয়েক জনকে খতম করে দিতে পারলে কোনও কোনও বুদ্ধিজীবী কমিউনিস্ট নিরাপদ দূরত্বে, খবর কাগজে তা পড়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। সে সময়ের মাওবাদীদের বন্ধু তৃণমূল, সিপিএম তাদের প্রধান শত্রু। তাই দুর্নাম নেই এমন সিপিএম নেতাকে হত্যা করতেও তাদের দ্বিধা নেই কোনও। স্রেফ পুলিশের চর সন্দেহে নিরীহ শিক্ষক খুন হলেন, লাশ গায়েব হল। যে নিরপেক্ষ জনসাধারণের কমিটি এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠের সাহায্য নিয়ে খাল কাটা বা প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার মতো উন্নয়নের কাজ সবে শুরু করেছে, তার মধ্যেও ঢুকে পড়ল মাওবাদীরা। ফলে, এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অভাব নিরসনের যে আন্দোলন শুরু করেছিল এই কমিটি, তাতে দলীয় রাজনীতির রং লেগে অচিরেই শুরু হল ভাটার টান। যে শহুরে বিদ্বজ্জনেরা ঘটা করে জনসাধারণের কমিটির আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়াতে জঙ্গলমহলে ছুটে গিয়েছিলেন, কমিটিতে মাওবাদী ছাপ লাগতেই তাঁদের অনেকেই পিছিয়ে গেলেন। তার পর জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ। চলে গেল কিছু নিরীহ মানুষ। কেউ দায় নিল না এই বর্বরতার। কানাঘুষোয় জানা গেল এ মাওবাদীদের কাণ্ড। তারা হিসাবের ভুলে এই কাণ্ড করেছে। মাওবাদীরাও জোর গলায় নিন্দা করলেন না এই অমানবিকতার।
রাষ্ট্রের বদলা ইতিমধ্যেই আরও নির্মম হয়ে উঠেছে। জঙ্গলে ঘুমন্ত মাওবাদী ছেলেমেয়েদের শুয়োরমারা করে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখা গেল গামছায় ঢাকা মাওবাদী মুখ, কোটেশ্বর রাও ‘কিষেণজি’। যদিও মাওবাদীরা রাষ্ট্রের বুর্জোয়া নির্বাচন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেন না, কিন্তু তাঁদের এই মুখপাত্র আড়াল থেকে জানালেন, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। অপরিণামদর্শী কাজকর্মে, হঠকারিতায় ক্ষমতা কমতে শুরু করে মাওবাদীদের। ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১ কিষেণজি নিহত হওয়ার পর এ রাজ্যে দল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর, কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, আবার নাকি তাদের ঘোরাফেরা শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।

ঠিক এই সময়েই তাদের ভুল স্বীকার। তাদের বিবৃতি অনুযায়ী ভুলের তালিকা এই রকম: ১) মমতা কোন শ্রেণির প্রতিনিধি, এ ব্যাপারে যথেষ্ট স্পষ্টতা না থাকা, এর ফলে সিপিএম হারলে যৌথবাহিনী প্রত্যাহার হবে ও রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পাবে এবং তাতে আমাদের সুবিধা হবে, এ ধরনের মনোভাব তৈরি হওয়া। ২) এই মনোভাবের ফলে যৌথ-কর্মসূচির নামে মমতার মিটিং-মিছিলে নিজেদের প্রভাবিত জনগণকে ব্যাপক ভাবে পাঠানো। যে অবস্থাটায় নিজেদের সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থের ফসল তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল, ফলে ব্যবহার করার পরিবর্তে নিজেদেরই ব্যবহৃত হয়ে যেতে হল। ৩) কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারের সঙ্গে শান্তিবার্তা সম্পর্কে জারি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের প্রকাশ্য বিবৃতি না মানলে শান্তিবার্তায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও মমতার ‘শান্তিবার্তা’র ফাঁদে পা দেওয়া। ৪) একটা সময় যখন জঙ্গলমহলে (আন্দোলন) তুঙ্গে ছিল, তখন অনুকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও ঠিক সময়ে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জনগণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গ্রাম ও আঞ্চলিক স্তরে রূপ দিতে না পারা। ৫) লালগড় আন্দোলন ছিল এক বিদ্রোহ, কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে প্রকাশ্য ঘোষণা না করে লাশ গায়েব করা, সিপিএম এবং তাদের হার্মাদবাহিনীর কুকর্মের অতিপ্রতিক্রিয়া হিসেবে একই ভুলের শিকার হওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ভুলের ফলে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তাদের অপছন্দ করেছে, রাজ্যে তাদের প্রধান ঘাঁটি জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ নিশ্চয়ই তাদের ক্ষতি। তবে মস্ত ক্ষতি যে কোনও প্রতিবাদী মুখের, যাদের আজ মাওবাদী তকমা লাগিয়ে রাষ্ট্রের তরফে আক্রমণ করা অনেক সহজ। কারণ, সরকার বুঝে গেছে, আক্রমণ করলে সর্বব্যাপী প্রতিবাদ হবে না। কিছু বুদ্ধিমান আবার সমাজের ‘গ্যাংগ্রিন’ ছেঁটে ফেলা দরকার, এই যুক্তি শানিয়ে রাষ্ট্রকেই সমর্থন জোগাবেন।

মাওবাদীরা যে ভুল স্বীকার করেছেন, তাও বালখিল্য ধরনের। যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন, তাঁর শ্রেণি নিয়ে নাকি অস্পষ্টতা! মুখ্যমন্ত্রী জন্মগত ভাবে যে শ্রেণি থেকেই এসে থাকুন, পদে বসবার পর তিনি তো রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। ভোটের আগে হাজার-একটা বিপ্লবী স্লোগান দিলেও তাঁর যে ক্ষমতা হবে না কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে যৌথবাহিনী প্রত্যাহার করানোর— এ সহজ সরল সত্যটি তাঁরা আগে বোঝেননি! অতীতে কমিউনিস্ট বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে (সব নয়) বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিলেও, মামলা প্রত্যাহার করলেও, সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহারের প্রশ্ন ছিল না। উল্টো দিকে, মমতা প্রথম থেকেই কংগ্রেস দলের, কমিউনিস্ট আদর্শে তাঁর দীক্ষা বা তা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা নেই কোনও দিন। তবু চিনতে ভুল!

ভুলের তালিকা পড়ে আভাসে-ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে যে, শান্তি আলোচনার নামে ডেকে এনে কিষেণজিকে খুন করা হয়েছে। সত্যিই আকস্মিক এ আঘাত। কিন্তু এমন তো নয় যে, এ ঘটনা প্রথম ঘটল ভারতবর্ষে। অনতিঅতীতেই, অন্ধ্রে রাজশেখর রেড্ডিকে ক্ষমতায় চেয়েছিল মাওবাদীরা, তিনি ক্ষমতায় এলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়েছিল মাওবাদীরা। অনতিপরেই, জঙ্গলের মধ্যে ‘সংঘর্ষে মৃত্যু’ ঘটেছিল বেশ কিছু মাওবাদীর। তারও পরে, কিষেণজির মতোই ওয়ারাঙ্গলের জঙ্গলঘেরা গৌরাপ্পা পাহাড়ে ‘সংঘর্ষে মৃত্যু’ ঘটে বিশিষ্ট মাওবাদী নেতা সুধাকর রেড্ডির। এর পরেই শান্তি আলোচনায় যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেন মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক। সেই নির্দেশ অমান্য করে যে এ রাজ্যের মাওবাদীরা ‘শান্তিবার্তা’ এগিয়ে নিয়ে গেলেন, তা তো তাঁদেরই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শৃঙ্খলাভঙ্গ!

যাঁরা জঙ্গি কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস নজরে রেখেছেন, তাঁরা জানেন, এই ভুলগুলি অতীতেও হয়েছে— ১৯৪৯ সালে অল্পস্বল্প, ১৯৭০ সালে বৃহদাকারে। অর্থাৎ, এই ভুলগুলি অতীতের পুনরাবৃত্তি মাত্র। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের পরে তো পঞ্চাশ বছর হতে চলল, সেই আন্দোলনের ইতিবাচক দিক এবং তার ব্যর্থতা থেকে কোনও শিক্ষা নেওয়া গেল না? কেন বারংবার একই রকম ভুল হয়, যার পরিণামে শাস্তি পায়, নিহত হয় কিছু সাধারণ মানুষ এবং দলের তরুণ প্রতিশ্রুতিময় কমরেডরা? আজ মাওবাদীরা ভুল স্বীকার করে পার পেতে চাইছেন। কিন্তু যে নির্দোষ প্রাণগুলি চলে গেল, সে তাঁদের কমরেডদেরই হোক আর বিরুদ্ধমতাবলম্বীদেরই হোক, পারবেন তাঁরা সেই আকস্মিকের খেলায় নিহত মানুষগুলিকে ফেরাতে? একটি প্রাণ হরণ করার আগে দু-এক বার ভাবা হবে না? জীবন কি গাঁজাপার্কের চিনেবাদামের খোসা? না কি তেঘরিয়া-হাওড়া মিনি বাস টিকিট? যা অনাদরে ধুলোয় ফেলে দেওয়া যায়?

প্রচারপত্রের শেষে ‘আন্তরিক’ দুঃখ প্রকাশ করে মাওবাদীরা জনসাধারণকে বলেছেন, ‘...আপনারা আমাদের ভুলগুলির গঠনমূলক সমালোচনা করুন, বিভিন্ন ধরনের শলাপরামর্শ দিন। আপনাদের পরামর্শগুলোকে আমরা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব এবং উপযুক্ত শিক্ষা নেব।’ এই বাক্যবন্ধ পড়ে, আমাদের অনেকের পরিচিত এক সাদা মাথার নকশাল-দিদি বলেছেন, এটি আসলে ওই বিয়ের নেমন্তন্ন চিঠিতে, ‘পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়’ মডেলে বিধিসম্মত ক্ষমা প্রার্থনা। তবে কি মাওবাদীদের এই পাঁচ দফা ভুল স্বীকার, দুঃখপ্রকাশ আদতে ‘বিধিসম্মত আত্মসমালোচনা’? না কি রাজ্যবাসীর মন পাওয়ার কৌশল মাত্র?

প্রশ্নগুলি থেকেই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE