গণ্যমান্য নহেন, নিতান্ত সাধারণ মানুষ। দেশের একশত ত্রিশ কোটির মধ্যে একশত উনত্রিশ কোটিরও অধিক মানুষ যেমন, তেমনই। তাঁহারা ট্রেন হইতে নামিয়া ওভারব্রিজ পার হইয়া ঘরে ফিরেন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াইয়া মন্দিরে পূজা দেন। তাঁহারা বাসে চড়েন, নৌকায় নদী পারাপার করেন, কালেভদ্রে সিনেমা দেখিতে যান। তাঁহাদের সন্ততি অসুস্থ হইলে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। এই ম্লান, গরিমাহীন ভারতেরও যে বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার আছে, তাঁহাদের প্রাণের মূল্যও যে কানাকড়ি কম নহে, আরও কত বৎসর পার হইলে রাষ্ট্র, সমাজ তাহা স্বীকার করিবে? কলিকাতার রেড রোডে যে মুহূর্তে কার্নিভাল চলিতেছিল, তখন সাঁতরাগাছি স্টেশনে পদপিষ্ট হইয়া মারা গেলেন দুই জন। আহত আরও অনেকে। আপাত কারণ, একই সময়ে অনেকগুলি ট্রেন আসিয়া গিয়াছিল। প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তনের ঘোষণা হয়, ফলে একই সময়ে অনেকে ওভারব্রিজে উঠিয়া পড়েন। প্রকৃত কারণ, প্রতি দিন যাঁহারা এই স্টেশন ব্যবহার করেন, করিতে বাধ্য হন, তাঁহাদের জীবন রাষ্ট্রের চক্ষে মূল্যহীন। ফলে, সাঁতরাগাছি রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু তাহার পরিকাঠামো উন্নত হয় নাই। সে কথা সম্ভবত রেল কর্তৃপক্ষ ভাবিয়াও দেখেন নাই। হাওড়া স্টেশনের চাপ কমাইতে তাঁহাদের আরও একটি স্টেশন প্রয়োজন ছিল— তাঁহারা সাঁতরাগাছিকে বাছিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু, স্টেশনটিকে যে সেই বর্ধিত ভার বহনের যোগ্য করিয়া তুলিতে হইবে, সেই কথা বিবেচনা করিতে তাঁহাদের ভুল হইয়া গিয়াছিল। ভুলের কারণটি অনুমান করা চলে। তাঁহাদের নিকট যাত্রীরা সংখ্যামাত্র, তাহার অধিক কিছু নহেন। রেল চলিলে এই সংখ্যাগুলি প্ল্যাটফর্মে আসিবে, ওভারব্রিজ পার হইবে— তাহার অধিক আর কী? তাঁহাদের জীবনগুলিকে যথাযথ মূল্য দেওয়ার কথা, অতএব, ভাবনায় আসে নাই।
অথচ, এই দুর্ঘটনা এড়াইতে খুব বেশি কিছু করিবার প্রয়োজন ছিল না। ওভারব্রিজের সংখ্যাবৃদ্ধি, এবং সেগুলিকে প্রশস্ততর করিয়া তোলা জরুরি ছিল। ট্রেন চলাচলের ঘোষণা যথাসময়ে করা বিধেয় ছিল। এবং প্রয়োজন ছিল নজরদারির। যে মুহূর্তে অনেকগুলি ট্রেন একই সঙ্গে স্টেশনে আসিতেছে, তখন হুড়াহুড়ি পড়িয়া যাইবে, তাহাই স্বাভাবিক। বস্তুত, দুর্ঘটনা ঘটিবার পর ব্রিজে যে নজরদারি চলিতেছে, নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা যে ভাবে বাড়িয়াছে, তাহার অর্ধেকও যদি নিয়মিত ভিত্তিতে থাকিত, তাহা হইলেই সম্ভবত এই মর্মান্তিক ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব হইত। কিন্তু, কাজগুলি দুরূহ না হইলেও, তাহা করিতে হইলে গোড়ায় প্রয়োজন কথাগুলি ভাবা। এবং, সেই ভাবনা তখনই আসে, যখন মানুষের জীবন মূল্যবান বোধ হইতে থাকে। ঠিক যেমন ভিআইপি-দের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়, বিপদের যাবতীয় সম্ভাবনা আগাম বিচার করিয়া তাহা প্রতিরোধের আয়োজন হয়। সাঁতরাগাছিতে যাঁহারা মারা গেলেন, যাঁহারা আহত হইলেন, তাঁহারা ভিআইপি নহেন। কিন্তু, তাঁহাদের প্রাণও, অতি সীমিত সংখ্যক মানুষের নিকট হইলেও, অমূল্য। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এই অতি সাধারণ কথাটি বুঝিতে অস্বীকার করে বলিয়াই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিতেই থাকে। ২০১৭ সালে মুম্বইয়ের রেল স্টেশনে মারা গিয়াছিলেন অন্তত ২৩ জন। ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশে নবরাত্রির দিন ব্রিজে পদপিষ্ট হইয়া মারা যান শতাধিক মানুষ। কুম্ভ মেলা হইতে শবরীমালা মন্দির, পটনা হইতে চেন্নাই, গত দশ বৎসরেই শুধু পদপিষ্ট হইয়া মৃত্যুর ঘটনা বিপুল। এবং, তাহা রাষ্ট্রীয় অবহেলায় মোট মৃত্যুর একটি অংশমাত্র। এত প্রাণহানিতেও কি হুঁশ ফিরিবে না? দুর্ঘটনার পূর্বেই সতর্ক হওয়ার মতো সচেতন কি হইবে না প্রশাসন? ভাবিবে না, এই অহেতুক প্রাণহানি আর চলিতে পারে না? কত হাজার মরিলে তবে রাষ্ট্র মানিবে যে সত্যই বড্ড বেশি মানুষ বানের জলে ভাসিয়া গেল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy