Advertisement
০৫ মে ২০২৪
economy

বিপরীত গতি

ভারতে আর্থিক সঙ্কটের চিত্রটি যে গভীর উদ্বেগের কারণ, তাহা লইয়া নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই।

প্রতীকী  ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২১ ০৪:৫৩
Share: Save:

কমলকুমার মজুমদার জানিতেন— তীর সম্মুখ গতি যাইবার নিমিত্তে পিছু হটে, সর্পও দংশন করিবার পূর্বে আপনাকে পিছন পানে টানিয়া লয়। সুনামি আসিবার আগে সমুদ্র কূল হইতে দূরে সরিয়া যায়, তাহাও মানুষ জানিয়াছে। কিন্তু অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিও যে অনুরূপ হইতে পারে, সেই সত্য তুলনায় কম পরিচিত। সম্প্রতি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত পরিসংখ্যান এমন বিপরীত গতির একটি নিদর্শন হাজির করিয়াছে, ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে যাহা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কোভিড অতিমারির আক্রমণের পরে চলতি অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে জিডিপি বা জাতীয় আয়ের অনুপাতে ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক (হাউসহোল্ড) সঞ্চয়ের হার প্রচুর বাড়িয়া গিয়াছিল। এক বৎসর আগে দেশে মোট ব্যক্তিগত সঞ্চয় ছিল জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ, ২০২০’র এপ্রিল হইতে জুন মাসের হিসাবে তাহা ২১ শতাংশে পৌঁছয়। কিন্তু সঞ্চয়ের এই ‘উন্নতি’ ছিল একটি দুর্লক্ষণ। এই বাড়তি সঞ্চয়ের কারণ ইহাই যে, প্রথমত, লকডাউনের ফলে বাজারে ঝাঁপ পড়িয়া যাইবার ফলে বহু খরচ করা সম্ভবই ছিল না এবং দ্বিতীয়ত, বহু মানুষ দুর্দিনের আশঙ্কায় স্বাভাবিক খরচ বন্ধ রাখিয়াছিলেন। অতিমারির ফলে আয় কমিয়াছিল, কিন্তু যাঁহারা সঞ্চয় করিতে পারেন সেই বর্গের মানুষের আয় অপেক্ষা ব্যয় কমিয়াছিল অনেক বেশি। সঞ্চয়ের অনুপাতে অস্বাভাবিক উন্নতি তাহারই পরিণাম।

এই বৃদ্ধি স্থায়ী হইবার কথা ছিল না, স্থায়ী হয়ও নাই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলিতেছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্বে অর্থাৎ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেই ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের অনুপাত নামিয়াছে ১০.৪ শতাংশে। পরবর্তী তিন মাসে এই হার যে আরও কমিয়াছে, তাহা প্রায় নিশ্চিত। এক দিকে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক হইতেই বাজারহাট খুলিয়া গিয়াছে, অন্য দিকে অধিকাংশ পরিবারেরই নূতন করিয়া সঞ্চয় বাড়াইবার সংস্থান হয় নাই, বরং বহু মানুষের আয়ের অঙ্কে টান পড়িয়াছে। অনেকেই কাজ হারাইয়াছেন, অনেকের মজুরি ও বেতন কমিয়াছে, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের আয়ও মন্দাক্রান্ত। এই সমস্যা বাড়িতেছে। প্রত্যাশিত ভাবেই সঞ্চয়ের অনুপাত নামিতেছে। তাহার পাশাপাশি, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাব বলিতেছে, বাড়িতেছে পারিবারিক ঋণের অনুপাত— প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপির ৩৫ শতাংশ হইতে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেই তাহা ৩৭ শতাংশ দাঁড়াইয়াছে। গড়পড়তা ভারতীয় পরিবারগুলির আর্থিক কাঠামো স্বাভাবিক অবস্থাতেই দুর্বল, মন্দার কবলে পড়িয়া দুর্বলতা দ্রুত বাড়িতেছে।

ভারতে আর্থিক সঙ্কটের চিত্রটি যে গভীর উদ্বেগের কারণ, তাহা লইয়া নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। অতিমারিজনিত সঙ্কটের মোকাবিলায় নিষ্ক্রিয় থাকিবার বিষয়ে গোটা দুনিয়ায় নরেন্দ্র মোদীর সরকারের তুলনা বিরল, সে কথাও ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট এই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবের একটি দিকের উপর নূতন আলো ফেলিতেছে। সঞ্চয়ের হ্রাস এবং ঋণের বৃদ্ধি— দুইয়ের সম্মিলিত ফল নাগরিকের ভবিষ্যৎকে উত্তরোত্তর অনিশ্চিত ও সমস্যাসঙ্কুল করিয়া তুলিবে। মনে রাখা দরকার, দারিদ্রের সমস্যাটি নিছক দরিদ্রের সংখ্যা বা অনুপাতের বিষয় নহে, সেই সংখ্যার পিছনে থাকে অর্থনীতির প্রক্রিয়া। এক একটি আর্থিক মন্দার প্রকোপে বহু নাগরিকের আর্থিক অবস্থার দ্রুত যে অবনতি ঘটে, তাহার ক্ষতিপূরণ করিতে দীর্ঘ সময় কাটিয়া যায়, অনেকের ক্ষেত্রে তাহার আর কোনও দিনই পূরণ হয় না। বিশেষত, ঋণের ফাঁদে পড়িয়া বহু মানুষের জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যানে এই বিপদের লক্ষণ সুস্পষ্ট। ভাইরাসের বিপদ এক দিন বিদায় লইবে। অর্থনীতির বিপদ উত্তরোত্তর বাড়িতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE