E-Paper

বৈষম্য সংস্কৃতি

সম্প্রতি আইআইটি ক্যাম্পাসে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট, মৃত পড়ুয়াদের অধিকাংশই আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০২
teacher.

—প্রতীকী ছবি।

ফেল করিয়ে গর্ববোধ করা— শিক্ষকদের এই মানসিকতা নিয়ে সম্প্রতি সরব হয়েছে আইআইটি দিল্লির শিক্ষার্থীদের একাংশ। গত দু’মাসে সেই ক্যাম্পাসে দুই দলিত শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনার পর তাদের দাবি, শিক্ষকদের পড়ানোর ধরন, কম নম্বর-প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁদের ব্যবহার, কোনও নির্দিষ্ট কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর ভাল করতে না পারলে সম্পূর্ণ অন্য একটি কোর্সে শিক্ষার্থীকে বদলি করে দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি আবশ্যক। এবং তারা বলেছে, শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলে তা বাস্তবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ব্যর্থতাকেই প্রতিফলিত করে। জরুরি কথা। কথাটি শুধুমাত্র আইআইটি-র মতো দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই নয়, কার্যত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নিজস্ব বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বেছে নেওয়ার পরও তাদের একাংশ যদি পরীক্ষায় কৃতকার্য না হতে পারে, তবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকরা দায় এড়াতে পারেন কি? শিক্ষার্থীরা অসফল হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা সবিশেষ লজ্জার, গর্ববোধের বিষয় নয়।

লজ্জা আরও একটি কারণে। সম্প্রতি আইআইটি ক্যাম্পাসে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট, মৃত পড়ুয়াদের অধিকাংশই আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ইতিপূর্বেও এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে যে, প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের এখানে র‌্যাঙ্ক, গ্রেড, জাত, ধর্ম, ইংরেজি বলতে না-পারা, পরিবারের আর্থিক অবস্থা-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজেদের ‘যোগ্য’ প্রমাণ করতে হয়। বিশেষত, সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে যারা এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে, ‘কোটায় আসা ছাত্র’ বলে সহপাঠী তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও তাচ্ছিল্যের মুখে পড়তে হয়। অথচ, ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা অনুসারে, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, কর্মক্ষেত্র, রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মতো বিভিন্ন জায়গায় নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন বরাদ্দ করেছিল সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের সামনের সারিতে তুলে আনার লক্ষ্যে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালুর এই মূল কথাটিকে গুরুত্ব দিতে হলে শুধুমাত্র আইআইটি নয়, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে পাঠক্রমকে আরও নমনীয় করে তোলা, পাঠদানের রীতিতে পরিবর্তন অবশ্যকর্তব্য। এই কাজে সামান্যতম অবহেলা শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটিকে গুরুত্বহীন করে তোলে। অথচ বাস্তবে সেই কর্তব্য যে পালন করা হয় না, একাধিক আত্মহত্যার ঘটনায় তা প্রমাণিত।

সর্বোপরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি মুখে বৈষম্য-বিরোধিতার বোর্ড লাগিয়ে রাখলেও সেখানে জাতপাতের বৈষম্যের প্রশ্নটি বার‌ বার উঠে আসছে কেন, সেই বিষয়েও আত্মবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বইকি। নিয়মনীতি কেবল খাতায়-কলমে, নজরদারির বিন্দুমাত্র ব্যবস্থাও নেই? যাবতীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ গড়ার কারিগর মনে করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে লাগাতার অ-শিষ্টাচার, ঔদ্ধত্যই যদি ‘স্বাভাবিক ধর্ম’ হয়ে দাঁড়ায়, সহপাঠীকে সহ-নাগরিক হিসাবে না ভেবে তার জাত-ধর্মভিত্তিক পরিচিতিই যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা হলে ভবিষ্যৎ সমাজের চেহারাটা কী হবে, ভেবে দেখা হচ্ছে কি? না কি তেমন সমাজই এখন আরাধ্য?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education Teacher Students

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy