E-Paper

অকর্তব্য

এ রাজ্যে হামেশাই উলটপুরাণ ঘটে। শিক্ষকরা নির্বাচন বা জনগণনার কাজে যুক্ত হন, আর পুলিশ অবতীর্ণ হন শিক্ষক বা প্রবীণদের বাজার সরকারের ভূমিকায়।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৩ ০৫:৪২
An image of Civic Volunteers

পাঠদানের দায়িত্বটি স্কুলশিক্ষকদের উপর নয়, বরং ন্যস্ত হবে শতাধিক সিভিক ভলান্টিয়ারের উপর। প্রতীকী ছবি।

বাঁকুড়ায় জঙ্গলমহল-সহ পিছিয়ে পড়া এলাকায় প্রাথমিক পড়ুয়াদের মেধার বিকাশের জন্য বিশেষ ক্লাসের পরিকল্পনা করেছে জেলা পুলিশ। ‘অঙ্কুর’ নামের এক প্রকল্পের অন্তর্গত ৪৬টি স্কুল-সহ মোট ৫৫টি কেন্দ্রে অঙ্ক এবং ইংরেজির বিশেষ পাঠের সুযোগ পাবে পড়ুয়ারা। কিন্তু, পাঠদানের দায়িত্বটি স্কুলশিক্ষকদের উপর নয়, বরং ন্যস্ত হবে শতাধিক সিভিক ভলান্টিয়ারের উপর। স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্ক দানা বেঁধেছে এই সিদ্ধান্ত ঘিরে। অবশেষে পুলিশ বিবৃতি দিয়েছে যে, স্কুলে নয়, এই ক্লাস হবে অন্য কোথাও। এ-হেন উদ্যোগ অবশ্য নতুন নয়। গত বছরও ঝাড়গ্রামে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ করে দিতে কোচিং সেন্টারের পরিকল্পনা করে সেখানকার পুলিশ-প্রশাসন। তার জন্য মোতায়েন করা হয় সাড়ে চারশোরও বেশি পুলিশকর্মী।

ভাবনা যা-ই হোক না কেন, সিদ্ধান্তটিতে বাস্তববোধের অভাবটি স্পষ্ট। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এক জন প্রাথমিক শিক্ষককে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর ডিএলএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হয়। অর্থাৎ, পেডাগজি বা শিক্ষাবিদ্যার দর্শন একেবারে প্রাথমিক স্তরে পড়ানোর জন্যও যে বিশেষ যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের কথা বলে, রাজ্যের সরকারি নীতি সেই বিষয়টি সম্বন্ধে অনবহিত নয়। শুধু সিভিক ভলান্টিয়ার কেন, থানার আধিকারিক বা হাসপাতালের ডাক্তার অথবা হেড অফিসের বড়বাবু, কারও এই যোগ্যতা নেই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষকের ঘাটতি এ রাজ্যে প্রকট; বহু ক্ষেত্রেই যাঁরা প্রাইভেট টিউশন পড়ান তাঁরা তো বটেই, এমনকি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নির্বাচনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই যথেষ্ট যোগ্য নন। কিন্তু, কোনও সরকারি দফতর যদি নীতিগত ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, যাঁদের শিক্ষকতার যোগ্যতা নেই তাঁদের দিয়েই শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করা হবে, তবে তা ঘোর উদ্বেগের কথা। এই কাজটিকে পুলিশ যদি জনসংযোগের মাধ্যম বলে বিবেচনা করে, তবে তা কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়। স্কুলের শিক্ষককে যেমন জনসংযোগের দোহাই দিয়ে থানা সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া যায় না, তেমনই সিভিক ভলান্টিয়ারদের জনসংযোগের নামে পড়ানোর কাজে নিয়োগ করা চলে না। এই হঠকারিতার মধ্যে আসলে শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে রাজ্যের পরিচালকদের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। সেখানে জোড়াতালি দিয়ে কোনও ক্রমে কাজ চালিয়ে যাওয়াই মূল কথা। অথচ, দীর্ঘমেয়াদি মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে— যা একই সঙ্গে ব্যক্তি-নাগরিক ও রাজ্যের অর্থব্যবস্থা, উভয়ের পক্ষেই অতি গুরুত্বপূর্ণ— প্রাথমিক শিক্ষায় জোর দেওয়া অত্যাবশ্যক।

অবশ্য, এ রাজ্যে হামেশাই এমন উলটপুরাণ ঘটে। শিক্ষকরা নির্বাচন বা জনগণনার কাজে যুক্ত হন, আর পুলিশ অবতীর্ণ হন শিক্ষক বা প্রবীণদের বাজার সরকারের ভূমিকায়। প্রশাসনিক কর্মীরা নিযুক্ত হন পঞ্চায়েতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক রং বিচারের কাজে, দলের নেতারা সরকারি প্রকল্পের কর্ণধার হয়ে বসেন। ভাবটা এমন, যেন যে-কেউ যে-কোনও কাজ করে দিতে পারে। ফলে, কোনও কাজেরই আর কোনও গুরুত্ব অবশিষ্ট থাকে না। সেই সামগ্রিক অব্যবস্থা বন্ধ হবে, পশ্চিমবঙ্গে বসে এমন দুরাশা করার সাহস নাগরিকের হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু অন্তত শিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলার প্রবণতাটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Civic Volunteers school Education Primary Schools

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy