Advertisement
০৩ মে ২০২৪
CAA

আইনের ফাঁদ

অন্য দেশের থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীকে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য সুযোগ দেওয়া— সাধারণ ভাবে নাগরিকত্ব আইনের এটুকুই লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল।

CAA

— ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৪ ০৫:৫৭
Share: Save:

কোনও আইন যখন পথের থেকে বেশি সংখ্যায় পথবন্ধক তৈরি করে, তার পিছনে কী থাকে? আর যা-ই থাক, সামগ্রিক নাগরিক সমাজ বিষয়ে মঙ্গলভাবনা থাকে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে এই হল সার কথা। চার বছর পর হঠাৎ মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহটিকেই কেন নাগরিকত্বের আইন পাশ করার জন্য প্রকৃষ্টতম লগ্ন হিসাবে বেছে নেওয়া হল, কথাটা সেখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আইনটি পাশের আগে থেকেই গোটা দেশ জুড়ে প্রবল প্রতিবাদ ও আতঙ্ক চলছিল। কোভিড-পর্বের অন্ধকার যবনিকা তার উপর পতিত না হলে সে আন্দোলন সরকারকে বিপন্ন বোধ করাতেই পারত। বিভিন্ন রাজ্য সরকারও জানিয়েছিল যে, সিএএ-তে তাদের সমর্থন নেই। সে সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য করে এত দিন ফেলে রাখা, অতি-বিতর্কিত, অতি-আশঙ্কিত সিএএ পদ্ধতি নির্দেশিকা প্রকাশিত হল এই মার্চে— জাতীয় নির্বাচনের ঠিক মুখে মুখে। এবং এমন এক সময়ে যখন নির্বাচনী বন্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে কড়া রায় দিয়েছে তাতে বিজেপি সরকারের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বিপুল। কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়টি কেবল কথার কথা নয়, তর্কশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্রের অন্তর্গত। আসন্ন ভোট এবং সিএএ-র মধ্যে কার্যকারণ এতই স্পষ্ট যে, তা দেখতে আজ আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির আতশকাচটি ঝেড়েমুছে বার করতে হচ্ছে না। কার্যকারণের পরিচয়? মুসলমান-বিরোধিতার নতুন রাস্তা তৈরি করে ধর্ম-অসহিষ্ণু হিন্দু ভোট আকাঙ্ক্ষা।

অন্য দেশের থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীকে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য সুযোগ দেওয়া— সাধারণ ভাবে নাগরিকত্ব আইনের এটুকুই লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল। দেশভাগের পর এমনিতেই এই বিষয়টিতে জটিলতার শেষ নেই। কিন্তু ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার হিন্দুরাজ্যের নির্মাণকল্পে আইনটি এমন ভাবেই সংশোধন করেছে, যাতে কোনও কোনও বিশেষ ধর্মের মানুষ সেই সুযোগ না পেতে পারেন। নাগরিকত্বের আবেদনের ক্ষেত্রে এই ধর্মভিত্তিক ভাগাভাগি— সরাসরি ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধতা। বিজেপি নেতাদের মুখে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, এ বার তাঁদের দল আবারও জিতে এলে সংবিধানেও বদল আসবে। সেই বদল আসার আগেই অসাংবিধানিক আইন? বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সুযোগ দেওয়াই নাকি সরকারের উদ্দেশ্য। কে কোন বৈষম্যের কারণে এসেছেন জানা যাবে কী করে, ধর্মীয় বৈষম্যের প্রমাণই বা হবে কী করে? কেনই বা এই তিন দেশকে বেছে নেওয়া হল? অন্য দেশ থেকে একই কারণে এলে কেন কেউ সমান সুযোগ পাবেন না? কী করে ধরে নেওয়া হল যে, মুসলমানরা মুসলমানদের উপর ধর্মীয় বৈষম্য করে না, যখন তার অজস্র প্রমাণ সামনেই মজুত? আর ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে একটি বিশেষ তারিখের আগে এলে তবেই গণ্য হবে, তার পরে এলে আর হবে না— এমনই বা কেন? কোনও মুসলমান পিতামাতা অনেক দিন আগেও যদি ভারতে এসে থাকেন, তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন না, আর ভারতের মাটিতে জন্মানো তাঁদের সন্তানসন্ততিও না?

জিজ্ঞাসা এখানেই শেষ নয়। আবেদনের সঙ্গে যে সব নথি চাওয়া হয়েছে, তা কেউ না দিতে পারলে কী হবে? আবেদনপত্র যদি খারিজ হয়ে যায় নথির অপর্যাপ্ততা বা অযথার্থতার কারণে, তবে কি আবেদনকারী ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে যাবেন— কেননা তিনি ইতিমধ্যেই নিজেকে ভিন দেশি বলে ঘোষণা করেছেন, এবং এই দেশও তাঁর আবেদন গ্রহণ করেনি? সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের মুখ চেয়ে হর্ষোল্লাসে মেতেছেন বিজেপি নেতারা, সেই মতুয়া সমাজ আদৌ লাভবান হবে কি? প্রশ্নগুলো কঠিন। কিন্তু উত্তর সব জানা। রাজনীতিটাও জানা। ভারতবর্ষের অসীম দুর্ভাগ্য যে নাগরিকত্বের মতো প্রশ্নে মানুষকে নিয়ে এই ক্লেদাক্ত রাজনীতি চলছে, চলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CAA BJP Amit Shah
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE