E-Paper

দুঃস্বপ্ন

ইউরোপে মানবমর্যাদার একটা উচ্চ স্থান আছে, সে কারণেই এত কিছুর পরেও বিদেশি বা ‘বিধর্মী’ পরিযায়ীদের জীবন রক্ষা পাচ্ছে।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩ ০৫:২২
Migrant Arrivals by Sea in Italy.

ইটালিতে পা রেখেছেন সতেরো হাজার মানুষ, গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ! ছবি: রয়টার্স।

কতটা পথ পেরোলে তবে পরিযায়ী বলা যায়? ইটালির সমুদ্র উপকূলে বা মাঝসমুদ্রে ভাসছেন হাজার হাজার মানুষ, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া থেকে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। নতুন বছরের তিনটে মাসও পেরোয়নি, এরই মধ্যে ইটালিতে পা রেখেছেন সতেরো হাজার মানুষ, গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ! ইটালির উপকূল রক্ষী বাহিনী, নৌবাহিনী ও বেসরকারি কল্যাণমূলক সংস্থার সদস্যরা মিলে দিন তিনেক আগেই উদ্ধার করেছেন হাজারেরও বেশি পরিযায়ী মানুষকে। এঁরা আসছেন লিবিয়া থেকে, সোমালিয়া, সুদান, ইথিয়োপিয়া, ইরিট্রিয়া, সেনেগাল থেকে, সিরিয়া থেকেও। বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রায় মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও শিশুসন্তানকে আঁকড়ে মাছ-ধরা ট্রলার বা রবারের নৌকায় চেপে পড়ছেন মা, স্বদেশের যুদ্ধ দাঙ্গা আর দারিদ্রকে পিছনে ফেলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে সমুদ্রশরণ নিচ্ছেন সন্তানসম্ভবা নারী, জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত পুরুষ। অগণিত শিশু জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখছে— অবাক চোখে নয়, আতঙ্কিত হয়ে। ‘হিউম্যান স্মাগলিং’ বা মানব পাচার হয়ে উঠেছে এক নিষ্ঠুর ব্যবসা, সমুদ্রে ভাসার আগে কষ্টার্জিত প্রায় সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে দিতে হচ্ছে পাচারকারীদের— জনপ্রতি সাড়ে সাতশো থেকে কখনও তা তিন-সাড়ে তিন হাজার আমেরিকান ডলারের সমতুল।

এই সব সমুদ্রযাত্রার অনেকগুলিই যে শেষ হয় না, ভূমধ্যসাগরের বুকে বা গন্তব্য দেশটির তীরে এসেও ডুবে যায় বহু তরী— সেই নির্মম বাস্তবটি ইদানীং বারংবার জেগে উঠছে। সে জন্যই আন্তর্জাতিক স্তরে উদ্ধারকার্যের, এবং বিশেষত যে দেশটি হয়ে উঠছে গন্তব্য, তার মানবিকতা ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার গুরুত্ব অপরিসীম। ফেব্রুয়ারির শেষে ইটালির ক্যালাব্রিয়া সাগরে পরিযায়ী-বোঝাই জাহাজ ভেঙে সত্তরেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, অভিযোগ উঠেছে— ইটালি উদ্ধারকার্যে তত গা করেনি। তা নিয়ে তদন্তও চলছে। রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বাধীন ইটালির রক্ষণশীল, দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের সরকারকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিযায়ী ঢেউ সামলাতে হচ্ছে, তারই প্রভাব পড়ছে সমুদ্রে মুমূর্ষুর উদ্ধারেও। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মেলোনির মন্ত্রিসভা কঠোর শাস্তি ঘোষণা করেছে, আইনি পথে অভিবাসনকে প্রসারিত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে, অন্য দিকে ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’-সহ বেসরকারি কল্যাণমূলক সংস্থাগুলির উদ্ধারকাজে নানা নিয়ম চাপাচ্ছে— পরিযায়ীদের উদ্ধার করে এনে ইটালির বন্দরে ভিড়বার মুহূর্তে বলা হচ্ছে হেথা নয়, অন্য কোনওখানে, আরও উত্তরে যাও। বাড়ছে জলযানগুলির জ্বালানির চাপ, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। তা নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা চলছে বিশ্ব জুড়ে, কিন্তু বিশ্বময় নজর এড়িয়ে প্রতি দিন ভাসছেন, ডুবছেন যাঁরা, তাঁদের অবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছে বড়ই কম।

এ এক দুঃসহ সঙ্কটচক্র, যেখানে একটি দেশ তার নাগরিককে ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু দিতে না পারায় মানুষ জন্মভূমি ছাড়ছেন, কিন্তু যে দেশে গিয়ে পৌঁছচ্ছেন দেখা যাচ্ছে সেও আদৌ স্বপ্নভূমি নয়, সেখানেও বৈষম্য নানাবিধ: ভাষার, ধর্মের, অর্থনীতির, জীবনযাত্রার। ইউরোপে মানবমর্যাদার একটা উচ্চ স্থান আছে, সে কারণেই এত কিছুর পরেও বিদেশি বা ‘বিধর্মী’ পরিযায়ীদের জীবন রক্ষা পাচ্ছে। যে অমূল্য জীবনগুলির সলিলসমাধি ঘটল, ঘটছে এখনও, প্রত্যহ— তাদের দায় কার, জন্মভূমির না স্বপ্নভূমির?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Italy migrants

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy