Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Padma Awards 2023

(অ)মূল্য

‘পদ্ম’ সম্মান ঘোষণয় তথাকথিত ‘অজানা’ কিছু মানুষের মুখ উঠিয়ে প্রচারপটু কেন্দ্রীয় সরকার স্বভাবতই প্রচারের সুযোগটি ছাড়েনি।

Picture of Dilip Mahalanabis.

চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৭
Share: Save:

এই বছরের শতাধিক ‘পদ্ম’ সম্মাননা প্রাপকের তালিকায় রয়েছেন প্রয়াত চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ। গত বছর অক্টোবরে তাঁর প্রয়াণের পরে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস)-এর মতো আক্ষরিক অর্থে প্রাণদায়ী ‘মহৌষধ’-এর ‘আবিষ্কর্তা’ এই মানুষটিকে নিয়ে সাড়া পড়েছিল— দীর্ঘ দিন সম্মিলিত সামাজিক বিস্মৃতির পর মরণোত্তর স্বীকৃতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী ক্যাম্পে উদরাময়-কলেরা-আন্ত্রিকের প্রকোপ নির্মূল করেছিলেন যিনি, যাঁর ওআরএস-এর কল্যাণে সারা পৃথিবীতে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ বেঁচেছে, এই কলকাতাতেই নীরবে শেষজীবন কাটানো সেই মানুষটির অতুল কীর্তি সবাই জানল তাঁর মৃত্যুর পরে। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা সেই মহৎ জীবনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেই সঙ্গে জানা গেল পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত এমন ছাব্বিশ জন মানুষের কথা, যাঁরা তথাকথিত অনামী অথচ তৎপর কর্মী, তন্নিষ্ঠ শিল্পসাধক, পরিবেশের প্রহরী, নিরভিমান সমাজসেবক।

‘পদ্ম’ সম্মান ঘোষণায় তথাকথিত ‘অজানা’ কিছু মানুষের মুখ উঠিয়ে প্রচারপটু কেন্দ্রীয় সরকার স্বভাবতই প্রচারের সুযোগটি ছাড়েনি। শিল্প শিক্ষা স্বাস্থ্য বিজ্ঞান সংস্কৃতির পরিসরে ছাপ রাখা সত্ত্বেও যাঁরা রয়ে যাচ্ছেন অপরিচয়ের আড়ালে, এই সরকার তাঁদের সামনে নিয়ে আসছে, তাঁদের কাজের স্বীকৃতি দিচ্ছে— এই হল বর্তমান সরকারের দাবি। দাবিটি এক অর্থে সঙ্গত। অন্য অর্থে, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রেরই বিরাট লজ্জা। তবে, সে লজ্জা কি বৃহত্তর সমাজেরও নয়? প্রচারবিমুখ যে চিকিৎসক মহামারি ঠেকিয়ে আন্দামানের জারোয়াদের বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, নাগাল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ মিজোরাম বা ঝাড়খণ্ডের জনজাতি ভাষা-সঙ্গীত-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপাত করছেন যে সংস্কৃতিকর্মীরা, আট দশক ধরে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের সেবায় রত কেরলের গান্ধীবাদী যে বৃদ্ধ, রাজ্য সরকার ভেবে ওঠারও কয়েক দশক আগে ‘অর্গ্যানিক’ চাষ-আবাদ চালু করে দিয়েছেন সিকিমের যে কৃষক, ১০২ বছর বয়সেও সারিন্দার সুরে শ্রোতার মন মজাচ্ছেন জলপাইগুড়ির যে শিল্পী, তাঁদের এবং এমনই আরও অগণিত প্রণম্যের প্রতিভা, শ্রম ও সাধনার খবর রাখেনি তাঁদেরই নিজেদের সমাজ— রাষ্ট্রের কথা তো বলাই বাহুল্য। চিকিৎসক মহলে তো দিলীপ মহলানবিশের অবদান অজানিত ছিল না, তা সত্ত্বেও জীবিতকালে তিনি কোনও রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি, সামাজিক স্বীকৃতিও নয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সম্মানের একমাত্র মানদণ্ড কি পুরস্কার? তা একেবারেই নয়। যাঁদের গভীর জনমুখী কিংবা ব্যতিক্রমী কাজ সামাজিক বা রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি লাভ করে, সম্মাননায় তাঁদের সাধনার ইতরবিশেষ হয় না, রাষ্ট্রই সেই সম্মান অর্পণ করে ধন্য হয়। সমাজ আত্মপ্রত্যয় লাভ করে। নাগরিকেরা এই বার্তা পান যে, তাঁদের জন্য রাষ্ট্র অসংবেদী নয়, সে মানীর মান রাখতে জানে। প্রসঙ্গত, দেশের সরকার এ-ও বুঝলে ভাল যে, কৃতী ব্যক্তির সম্মান তাঁর জীবৎকালে দেওয়াই যোগ্য। মরণোত্তর অর্পণে তা যেন সম্মাননা নয়, খানিকটা প্রায়শ্চিত্তের মতো দেখায়। সু-কাজের বিস্মৃতি অপরাধের শামিল— দেরিতে মনে করাটাও কাজের নয়, সে প্রবাদবাক্য যা-ই বলুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE