রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। —ফাইল চিত্র।
অনধিকার চর্চা বিষয়টি এখন এতই সর্বত্রবিহারী যে শব্দটির ব্যবহারও যেন ক্লান্তিকর। কিন্তু অনধিকারকেও কোন অসম্ভবের তলে পৌঁছিয়ে দেওয়া যায়, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রতি দিন তা দেখছে। উপাচার্য নিয়ে যে কুনাট্য এখন প্রত্যহের ঘটনা, কোনও নিন্দাবাক্য উচ্চারণই তার জন্য যথেষ্ট নয়। এত ঘন ঘন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ, বাতিল, পুনর্নিয়োগ ইত্যাদি কি পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে, না কি পশ্চিমবঙ্গই এই কৃতিত্বে সমগ্র ভুবনে একক এবং অদ্বিতীয়? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ছয় মাসের মধ্যে এ নিয়ে চার বার উপাচার্য বদল হল। সকলেই জানেন, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বন্দ্বক্ষেত্র হিসাবেই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনটি আপাতত মনোনীত হয়েছে। যাঁরা এই দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ যোদ্ধা, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালমন্দ নিয়ে কিছুমাত্র যায় আসে না, কেবল দ্বন্দ্বটি লড়ার জন্যই তাঁরা আনতাবড়ি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আগে একাধিক বার এ নিয়ে সমালোচনা এবং দুর্ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে— নতুন করে কিছু বলার অর্থ নেই, কেননা এই যোদ্ধা-চরিত্ররা কেউই শুভবোধের কথা শোনেন না, বলপূর্বক নিজেদের চার দিকে একটি দুর্ভেদ্য ক্ষমতান্ধতার প্রাচীর তৈরি করে রাখেন যাতে কোনও শব্দ ও সত্য সেখানে না পৌঁছয়। আলোচনা, সমালোচনা সবই এ দেশে এই মুহূর্তে অবান্তর। কর্তারা কেবল কর্তৃত্ববলে কর্ম করবেন, বাকি সব রবে নিরুত্তর। এটাই এখন দস্তুর।
তবুও একটি কথা না বলে থাকা মুশকিল। রাজ্যপাল মহাশয় স্থির করেছেন, নিজের দাপট দেখিয়ে তিনি যদৃচ্ছ উপাচার্য নিয়োগ ও বাতিল করবেন— কিন্তু যে সব ব্যক্তিকে তিনি টেনে আনছেন উপাচার্যের আসনে, শিক্ষার সঙ্গে তাঁদের সামান্য সংযোগও থাকা জরুরি ছিল না কি? সম্প্রতি আইপিএস অফিসারকেও উপাচার্য হিসাবে আসন দেওয়া হল। কেন? শিক্ষাব্যক্তিত্বের অভাব ঘটেছে, না কি বিশ্ববিদ্যালয় চালনার সঙ্গে শিক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই বলে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে? নানা ইঙ্গিত বলছে, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই উজ্জ্বল। সে ক্ষেত্রে বলা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতিষ্ঠান হলেও তাকে কিন্তু যে-কোনও প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা যায় না। শুধুমাত্র প্রশাসনিক শৃঙ্খলা রক্ষার অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালানোর ভাবনা কেবল ভুল নয়— আদ্যন্ত অনৈতিক। শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযোগ রাখা, শিক্ষাঙ্গনের শৃঙ্খলা বজায় রাখা— এ সব তাঁরই কাজ যিনি জানেন কী ভাবে শিক্ষাভুবন চলে, কী তার উদ্দেশ্য, কী সমস্যা, কী তার অগ্রাধিকার, কোথায় কার অধিকার। গোটা পৃথিবীতেই এই ধারা বহমান, শিক্ষাজগতের সঙ্গে সংযু্ক্ত ব্যক্তিত্বকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রেসিডেন্ট আসন পূর্ণ করা। এটুকু সামান্য জ্ঞান বা বোধ মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয়ের নেই, তা হতে পারে না। একমাত্র সম্ভাবনা, তিনি জেনেবুঝেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং এখানেই ঘোর সঙ্কট। রাজনীতির অতিব্যবহার এ রাজ্যকে উৎপীড়িত করে তাকে অসুস্থতার চরমে পৌঁছে দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও পার্টি অফিস, কিংবা প্রশাসনিক দফতরের শাখা করে তোলা দরকার? আর সবচেয়ে বড় কথা, এমন ধ্বংসকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও তৈরি করবে না রাজ্যের রাজনৈতিক সমাজ, নাগরিক সমাজ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy