Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Indian Economy

অলীক গৌরব

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন সাধারণ মানুষ নন, ফলে তিনি অঙ্কটি কষে মনে করিয়ে দিয়েছেন, দু’বছরে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের আয়তনে পৌঁছনো অসম্ভব।

An Image Of Raghuram Rajan

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৪
Share: Save:

আর দু’বছরের মধ্যে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আয়তন পৌঁছে যাবে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে? লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, এই মর্মে প্রচারও ততই জোরদার হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সচরাচর চক্রবৃদ্ধি হারের অঙ্ক কষেন না। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন সাধারণ মানুষ নন, ফলে তিনি অঙ্কটি কষে মনে করিয়ে দিয়েছেন, দু’বছরে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের আয়তনে পৌঁছনো অসম্ভব। অঙ্কটি রকেট বিজ্ঞান নয়— ইন্টারনেটে সহজেই সিএজিআর (কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট) ক্যালকুলেটর মেলে— তা ব্যবহার করে যে কেউ দেখে নিতে পারেন, আজকের ৩.৭ ট্রিলিয়ন থেকে দু’বছরের মধ্যে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে গেলে বার্ষিক আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে হয় ১৬.২৫%। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা তার নথিভুক্ত ইতিহাসে কখনও এই হারে বৃদ্ধি পায়নি; দুনিয়ার কোনও বৃহৎ অর্থব্যবস্থার পক্ষেই পর পর দুই অর্থবর্ষে ধারাবাহিক ভাবে এই বৃদ্ধির হার বজায় রাখা কার্যত অসম্ভব। এবং, এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির গতি ক্রমেই শ্লথ হয়েছে। কাজেই, পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থব্যবস্থার কথাটি নিতান্তই ‘জুমলা’— হিসাবে বিপুল পরিমাণ জল না মেশালে ভারতের পক্ষে ২০২৫ সালে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার আয়তনের অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই ভারতের বৃদ্ধির হার নিয়ে নির্মলা সীতারামনের ‘ভয়ঙ্কর সত্য’-র কথা আলোচিত হয়েছিল (১৯/১২)। প্রশ্ন হল, এই মিথ্যাচার কেন? কারণটি অনুমান করা কঠিন নয়। ভারতকে, বা তার বকলমে প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেখাতেই হয় যে, আর্থিক দিক থেকেও ভারত দুনিয়ায় অগ্রগণ্য শক্তি হয়ে উঠেছে। দেশের অভ্যন্তরে অপুষ্টি, ক্ষুধা, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, কোনও পরিসংখ্যানেই সে কথাটি বলার উপায় নেই। অতএব আর্থিক বৃদ্ধির আখ্যানকে বিভিন্ন ভগ্নাংশ ও ত্রৈরাশিকে পেশ করে গৌরব অর্জনের এই চেষ্টা।

একটা অন্য প্রশ্ন করা যাক— ভারত যদি সত্যিই পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়, তাতেই বা কী? দেশে আর্থিক বৃদ্ধি প্রবল রকম অসম, ফলে জাতীয় আয় বাড়লেও তা সবার জন্য সমান সুদিন আনে না, এই কথাটি তো সত্য বটেই, কিন্তু তারও আগে প্রশ্ন, জাতীয় আয়ের ওই অঙ্কটিরই বা অর্থ কী? জার্মানি ও জাপানের জিডিপি যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে ভারত এই দু’টি দেশকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে পৌঁছবে। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছিল যে, মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অঙ্কে ভারত এই দেশগুলির চেয়ে এমনই পিছিয়ে যে, তাদের মধ্যে তুলনাই চলে না। প্রথম বিশ্বের কোনও দেশের সঙ্গেই ভারতের তুলনা অর্থহীন। উন্নয়নশীল বিশ্বে ভারতের স্থান কোথায়? জনসংখ্যায় ভারতের নিকটতম দেশ চিন— বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০২২ সালের হিসাব অনুসারে তার মোট জিডিপি ভারতের সাড়ে পাঁচ গুণ, মাথাপিছু জিডিপিও। এমনকি, ভারত পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছলে, এবং চিনের অর্থনীতির আয়তন খানিক কমলেও এই ব্যবধান সাড়ে তিন গুণের। যে দেশগুলির সঙ্গে ভারত নিজের তুলনা করতে অভ্যস্ত, সেই ব্রাজ়িলের মাথাপিছু আয় ভারতের সাড়ে চার গুণ, মেক্সিকোর ক্ষেত্রে তা ভারতের প্রায় পাঁচ গুণ। এমনকি বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপিও ভারতের চেয়ে খানিক বেশি। মাথাপিছু আয়ে ভারতের সঙ্গে তুলনীয় দেশগুলি হল ঘানা, কঙ্গো, নিকারাগুয়া ইত্যাদি। ভারত পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের স্তরে পৌঁছলেও জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসন থেকে বহু দূরেই থাকবে। দেশের লোকসংখ্যা বেশি, তাই জিডিপিও বেশি, এটা তো গৌরবের কারণ হতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক এই কারণেই গৌরবান্বিত হয়ে বসে আছে, দেশবাসীকেও সেই ‘গৌরব’-এর আলোর ভাগ দিতে বদ্ধপরিকর। কে জানে, এই জুমলার ভাগীদার না হলেই হয়তো দেশদ্রোহী হিসাবে দেগে দেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE