Advertisement
০২ মে ২০২৪
Durga Puja 2023

‘মহা’-প্লাবিত

দেবীর অধিবাস, বোধন পেরিয়ে বাংলায় এই মহাষ্টমীতেই রবিবার অস্ত্র বা আয়ুধপুজো। দেবীর হাতের ত্রিশূল, ভল্ল, খড়্গ, তোমর ইত্যাদি অস্ত্রকে এ দিন স্নান করাতে হয়।

An image of Durga Idol

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪৬
Share: Save:

আজ মহাষ্টমী, আজ অস্ত্রপুজোর দিন। বাঙালি অবশ্য আজকাল পিতৃপক্ষে পুজোর উদ্বোধন করে, তার পর ‘মহা’প্লাবিত হয়। পুজোর উৎসব মানেই তার কাছে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী ইত্যাদি। চলমান ভাষা এবং জনসংস্কৃতির দিক থেকে বিষয়টি চমকপ্রদ। বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিধান হরিচরণ বন্দ্যোপায়ের কাছে আশ্বিনের শুক্লাষ্টমী মহাষ্টমী। মহাশঙ্খ, মহাস্নানের কথা বললেও মহানবমী শব্দটি তাঁর অভিধানে নেই। আর এক অভিধান রাজশেখর বসুর চলন্তিকা-য় অবশ্য মহাষ্টমী, মহানবমী দু’টি শব্দই আছে। শাস্ত্রগ্রন্থের মধ্যে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ক্রিয়াকাণ্ড বারিধি ও সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের পুরোহিত দর্পণ দুই বইয়েই মহাষ্টমী ও মহানবমীতে কী কী করতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা আছে। সোজা কথায়, মহাষ্টমী প্রথম থেকেই সগর্বে সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। পুজোর শেষ রাত বা মহানবমী বাংলা ভাষায় পরে স্বীকৃতি পেয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাতর ডাক ‘যেও না নবমী নিশি’ কে ভুলতে পারে! ব্যাসদেব কথিত ‘খিল হরিবংশ’তে আছে এক চিত্তাকর্ষক গল্প। বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণরূপে কংসের কারাগারে দেবকীগর্ভে জন্মানোর আগে মহামায়া বা মহানিদ্রাকে পাঠিয়েছিলেন। গর্ভ স্খলিত হয়, কংস শিশুকন্যাকে পাথরে আছাড় মারতেই সে পূর্ণ যুবতীর মতো নীল পীতাম্বর পরিহিতা, মুক্তকেশী, বিস্তীর্ণজঘনা, গজকুম্ভসদৃশ পয়োধরশালিনী কিন্তু চার হাত নিয়ে আকাশে উঠে যায়, অতঃপর ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’ ভবিষ্যদ্বাণী। অলৌকিক যুবতী কোথায় অন্তর্হিত হল? বিন্ধ্যপর্বতে, অরণ্যচারী বাঘ, সিংহবেষ্টিত হয়ে থাকতে। তিনিই বারাণসীর অদূরে, আজকের বিন্ধ্যবাসিনী দেবী। বিষ্ণু এটাও বলে দিয়েছিলেন, বলি তোমার অতিশয় প্রিয়। তুমি মহীমণ্ডলে নবমী তিথিতে পশুহিংসা সমন্বিত পুজো পেতে থাকবে। বহুতল হাউসিং কমপ্লেক্সে, পাড়ার মণ্ডপে বা বাড়িতে বাঙালি যে বেশির ভাগ সময় অষ্টমীতে নিরামিষ আর নবমীতে মাংসের দোকানের লম্বা লাইনে দাঁড়ায়, সেটি হরিবংশের অজানা ঐতিহ্য। আধুনিক জনসংস্কৃতিতে অনেক বিস্মৃত অতীতের অনুলেপ মিশে থাকে।

যেমন, অস্ত্রপুজো। দেবীর অধিবাস, বোধন পেরিয়ে বাংলায় এই মহাষ্টমীতেই আজ অস্ত্র বা আয়ুধপুজো। দেবীর হাতের ত্রিশূল, ভল্ল, খড়্গ, তোমর ইত্যাদি অস্ত্রকে এ দিন স্নান করাতে হয়। বলা বাহুল্য, মহাষ্টমী এবং কুম্ভমেলার শাহিস্নান ছাড়া আর কোনও দিন এই অস্ত্রপুজোর বিধি নেই। এবং বিধিটি এক-এক অঞ্চলে এক-এক রকম। বাংলায় অষ্টমী, কিন্তু তামিলনাড়ু ও উত্তরপ্রদেশে অস্ত্রপুজো দশমীর দিন, গুজরাতে নবমীতে। এক দেশ, এক ভোট বলে যাঁরা বিভোর থাকেন, একই দুর্গাপুজো, অস্ত্রপুজো অঞ্চলভেদে কত বিভিন্ন, তাঁদের নজর এড়িয়ে যায়। অস্ত্রগুলি পুরুষ দেবতাদের। শ্রীশ্রীচণ্ডীমতে, শিব তাঁর শূল থেকে আর একটি শূল, বিষ্ণু তাঁর চক্র থেকে আর একটি চক্র, ইন্দ্র তাঁর নিজের বজ্র থেকে আর একটি বজ্র উৎপাদন করে দেবীকে দেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ফি বছর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বেতার-অনুষ্ঠানের কল্যাণে বাঙালি আরও জানে, বরুণ দিয়েছিলেন শঙ্খ এবং পাশ, পবন ধনু ও তূণীর, যম কালদণ্ড। প্রতিটিই পূজনীয়। ত্রিশূলকে ‘ওঁ সর্বায়ুধানাং প্রথমো নির্মিতস্ত্বং পিনাকিনা’, তীক্ষ্ণ বাণকে ‘ওঁ সর্বায়ুধানাং শ্রেষ্ঠোহসি দৈত্যসেনানিসূদনঃ’ বলে প্রণাম করতে হয়। দেবীর বাহন সিংহ এবং মহিষাসুরকেও এই সময়ে প্রণাম করা বিধেয়, ‘ওঁ মহিষ ত্বং মহাবীর ইন্দ্রাদিদেবমর্দকঃ।’

হিন্দুধর্মসংস্কৃতি এখানেই চমৎকারা। মহিষাসুর বধের পর ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র চতুর্থ অধ্যায়ে অস্ত্রদানকারী পুরুষ দেবতারাই তেজোময়ী বিজয়িনীকে প্রণাম জানান, ‘দৃষ্টিমাত্রই আপনি সমস্ত অসুরকে ভস্ম করতে পারেন। তবু অস্ত্রপ্রয়োগ করেন, কারণ রিপুগণ এবং শত্রুগণও আপনার অস্ত্রাঘাতে নিষ্পাপ হয়ে উত্তম লোকে প্রয়াণ করে।’ দিব্যাস্ত্রের সঙ্গে দিব্যাস্ত্র, মানুষী অস্ত্রের সঙ্গে মানুষী অস্ত্রের এই সংযোগ আজকের যুদ্ধে অনুপস্থিত। প্যালেস্টাইন বা ইউক্রেনের অসমযুদ্ধেই হোক, বা ভারতে আজকের হিন্দুত্ববাদীদের গণপিটুনিতেই হোক, সমানে সমানে লড়াইয়ের সেই অস্ত্র-ঐতিহ্য সমূলে বিনষ্ট। নেই সেই সর্বজনের আরাধনাও। অস্ত্রপুজোর দেবীমাহাত্ম্যে এক কালে হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শূদ্র তফাত ছিল না। বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পর সুখ ও শান্তিকল্পে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকে যে এ বারেও ঘরে সম্বৎসরের জন্য দেবীর খাঁড়া বা চাঁদমালা রেখে দেবেন, কে না জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE