Advertisement
০২ মে ২০২৪
Nabadwip

স্থানমাহাত্ম্য

একটি অতি সাধারণ ঘটনাকেও নানা দিক থেকে দেখা ও ব্যাখ্যা করা যায়। যে কোনও দৃষ্টিভঙ্গিই দর্শকের মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসনির্ভর।

— ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ ০৮:১৮
Share: Save:

ভক্তিপ্রিয় মানুষ যাঁরা, তাঁদের মনের অনেকটা অধিকার করে থাকে ‘স্থানমাহাত্ম্য’। কোনও কোনও ধর্মস্থান কেন সবিশেষ গুরুত্বের, শাস্ত্রে ও মহাপুরুষবাক্যে স্থানগুলি সম্পর্কে কী লেখা আছে, তাদের ঘিরে লোকবিশ্বাস কেন এত গদগদ ইত্যাদি সব ধারণাই শব্দটির অন্তঃসার। বাংলার নবদ্বীপকেও এই আলোতেই দেখতে অভ্যস্ত ধর্মপ্রাণ বাঙালিরা: শ্রীচৈতন্যের জন্ম ও কর্মভূমি, তাঁর প্রবর্তিত-প্রচারিত ধর্মের পীঠ হিসাবে। তাই সেই জায়গাতেই নাস্তিক সম্মেলন হলে তা নজর কাড়ারই কথা। নাস্তিক মঞ্চ নামের একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে গত রবিবার নবদ্বীপে হয়ে গেল রাজ্যের প্রথম নাস্তিক সম্মেলন, অংশগ্রহণকারীরা পদযাত্রা করলেন ‘আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবিকে অস্বীকার করি’ ব্যানার নিয়ে।

একটি অতি সাধারণ ঘটনাকেও নানা দিক থেকে দেখা ও ব্যাখ্যা করা যায়। যে কোনও দৃষ্টিভঙ্গিই দর্শকের মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসনির্ভর। ধর্মের শহরে ধর্মে অবিশ্বাসীদের সম্মেলনে কেউ প্রমাদ গুনতে পারেন, তাকে দেখতে পারেন ধর্মের প্রতি আঘাত হিসাবে। আবার কেউ একে দেখতে পারেন স্রেফ আর একটি অনুষ্ঠান হিসাবে, গত বছর জন্ম-নেওয়া এক সংগঠন তাদের প্রথম সম্মেলনস্থল হিসাবে ঘরের কাছের সুবিধাজনক জায়গাটি বেছে নিয়েছে— নবদ্বীপের আলাদা গুরুত্ব তাদের কাছে না-ই থাকতে পারে। আবার কেউ বলতে পারেন এ-ও এক ধরনের প্রচারকৌশল, শ্রীচৈতন্যের শহরে নাস্তিক সম্মেলন করলে স্বাভাবিক ভাবেই তা লোক ও চোখ টানবে— ধর্মে অবিশ্বাসীরাও প্রকারান্তরে স্থানমাহাত্ম্যই স্বীকার করে নিলেন। আবার কেউ ভাবতে পারেন এ ভাবেই বুঝি ইতিহাসের এক-একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়— বাসুদেব সার্বভৌম, রঘুনাথ শিরোমণি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতো বাংলার দিকপাল পণ্ডিত, তার্কিক ও তাত্ত্বিকেরা যে স্থান আলো করে ছিলেন, যে ভূমি একদা ন্যায় স্মৃতি বেদান্ত তন্ত্র প্রভৃতি বিদ্যা-চর্চার পীঠভূমি ছিল, সেই নবদ্বীপই একুশ শতকে অন্য এক মতবাদ প্রচারের সাক্ষী থাকল। এ-ও যে এক বিদ্যা তা অস্বীকারের উপায় নেই, ভারতীয় সংস্কৃতিতে নাস্তিকতাও এক সুপ্রাচীন ‘দর্শন’, বুদ্ধ ও চার্বাকের পথ বেয়ে আজও তার উত্তরাধিকার নানা রূপে বাহিত।

নাস্তিক সম্মেলনের স্থানটি নিয়ে জনপরিসরে যত কথা, তার চেয়ে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য নিয়ে চর্চা হলে বরং কাজে দিত বেশি। কারণ স্রেফ ঈশ্বর বা ধর্মে আগাগোড়া অবিশ্বাসেই তাঁদের মতবাদের শুরু বা শেষ নয়, মানুষের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক জীবনের সঙ্গেও তার যোগ আছে। তাঁরা বলেছেন রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকতে পারে না, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ম, ধর্মস্থান বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত একেবারেই অবাঞ্ছিত; ব্যক্তিগত বিশ্বাস অন্য ব্যাপার, কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ধর্মীয় সমাবেশে যাতায়াত বা রাজনীতির মঞ্চে ধর্ম নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। সর্বোপরি তাঁদের চর্চা বিজ্ঞানমনস্কতা, কুসংস্কার-বিরোধিতা নিয়ে, জাতি-বর্ণ বিভেদের বিলোপ ও বাক্‌স্বাধীনতার প্রসার নিয়ে। এই সবই যে আজ প্রয়োজন তা ভারতীয়মাত্রেই মানবেন, এমনকি তিনি ধর্মে বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও। নবদ্বীপের মতো ধর্ম ও বিদ্যাচর্চার একদা-গৌরবভূমি থেকেই এই কাজের কথাগুলি ঘোষিত হল, মন্দ কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nabadwip Atheist Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE