দুয়ারে ডাক্তার প্রকল্প। ফাইল ছবি।
দুয়ারে ডাক্তার প্রকল্পটি মানবসম্পদ অপচয়ের একটি দৃষ্টান্ত বললে অত্যুক্তি হবে কি? কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের জেলার স্বাস্থ্য শিবিরে পাঠালে লাভ-ক্ষতির পাল্লা কোন দিকে ভারী হবে, সে বিবেচনার কোনও ছাপ নেই এই উদ্যোগে। কলেজগুলির প্রধান উদ্দেশ্য পঠনপাঠন এবং জটিলতর রোগের চিকিৎসা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে সেগুলি বিপর্যস্ত, এক-একটি বিভাগ কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় শিক্ষক-চিকিৎসকদের গ্রামে পাঠানো কতটা সঙ্গত? জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণাই এখন প্রশাসনিক নীতির জায়গাটি নিয়েছে। স্বাস্থ্য সচিবের ভূমিকা দাঁড়িয়েছে তালিকা-রচয়িতার— কত জন চিকিৎসক কবে, কোন জেলায় যাবেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশ জারি করার আগে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক সংখ্যা, এবং চিকিৎসকদের অন্যত্র পাঠানোর সম্ভাব্য ফল বিচারের কোনও চেষ্টাই করলেন না স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা। তাঁদের এই আজ্ঞাবাহী মনোভাবের ফলে চিকিৎসক মহলে বিভ্রান্তি এবং ক্ষোভ ছড়াচ্ছে, রাজকোষের অপচয় বাড়ছে, অথচ, নাগরিকের প্রয়োজন মিটছে না। আধিকারিকরা প্রশ্নহীন থাকলেও, দুয়ারে ডাক্তার উদ্যোগটি রাজ্য সরকারকে বেশ কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। যেমন, এসএসকেএম-এর চিকিৎসকরা ১৬০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে শিবির করলেন, অথচ সাতচল্লিশ কিলোমিটার দূরেই ছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। এতে কি রাজ্য সরকারই মেডিক্যাল কলেজগুলির মধ্যে ‘প্রথম শ্রেণি’ ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’ বিভাজনের ইঙ্গিত দিচ্ছে না? পরিষেবার চিত্রে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ভূমিকাই বা তা হলে কী?
দুয়ারে ডাক্তার নিয়মিত কর্মসূচি হলে মেডিক্যাল কলেজগুলি অচল হবে। যদি না হয়, তা হলে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নেই। এই হল রাজ্যের চিকিৎসা নীতির হাল। গ্রামের মানুষদের অবশ্যই অধিকার রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়ার। কিন্তু জেলার কোনও প্রেক্ষাগৃহে কিংবা স্কুল ভবনে স্বাস্থ্য শিবিরের ব্যবস্থা করলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পক্ষে কতখানি উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব? যে সব পরীক্ষার পরামর্শ তাঁরালিখে দেবেন, সেগুলি করানোর সুযোগ এই প্রকল্পে নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে রোগ নির্ণয় করার পরীক্ষার ব্যবস্থা আরও উন্নত না হলে, ওষুধের সরবরাহ নিয়মিত না হলে এতে কাজ হবে কতটুকু?
তবে সবচেয়ে বড় আপত্তি এই যে, দুয়ারে সরকার রাজ্য সরকারের চিকিৎসা নীতিরই বিরুদ্ধতা করছে। গ্রামবাসীদের কাছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই রাজ্য সরকার টেলি-মেডিসিনের সূচনা করেছিল। গত ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে, স্বাস্থ্য-ইঙ্গিত প্রকল্প এক কোটি মানুষকে পরিষেবা দিয়েছে। গ্রাহকসংখ্যার নিরিখে ভারতে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয়। তা হলে টেলি-মেডিসিনকে আরও বিস্তৃত, কার্যকর এবং উন্নত করা হচ্ছে না কেন? এই কার্যসূচির সঙ্গে আরও বিশেষজ্ঞ যোগ না করে, কেন এক-দু’দিনের জন্য বিশেষজ্ঞদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে শিবিরের আয়োজন করছে সরকার? সম্ভবত তার কারণ, টেলি-মেডিসিনের মতো প্রযুক্তি-নির্ভর, নিভৃত, নিয়মিত কার্যসূচিকে ঘিরে প্রচারের অবকাশ তেমন নেই। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, তাই হয়তো বৃহৎ প্রেক্ষাগৃহে, জেলাশাসকের উপস্থিতিতে, দুয়ারে ডাক্তার উদ্বোধনের ঘটাপটা আজ সুসংহত পরিষেবা দেওয়ার চাইতে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। সরকার যেন ভুলে গিয়েছে যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রদর্শন সরকারি চিকিৎসকের কাজ নয়। মেডিক্যাল কলেজগুলি স্বাস্থ্য দফতরের অধীন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। সর্বোপরি, রোগীর ভিড় দিয়ে চিকিৎসা পরিষেবার মূল্যায়ন করা চলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy